
আশরাফুল ইসলাম নিশাদ। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার উদ্যমী তরুণ। স্থানীয় কলেজে ডিগ্রির শিক্ষার্থী। আশপাশের অনেককে দেখে স্বপ্ন দেখেন ইউরোপে উন্নত জীবনের। দালালের মাধ্যমে চুক্তি করেন ইতালি যাওয়ার। দালাল স্বপ্ন দেখায় সহজেই লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথে ইতালি পৌঁছানোর। স্বপ্নে বিভোর নিশাদ পৌঁছে যান দুবাই হয়ে লিবিয়ায়। কিন্তু লিবিয়া পৌঁছানোর পর তার ঘোর কাটতে থাকে।
নিশাদের মতে, আমার মতো ভুল করে লিবিয়া এসে নিজের জীবন নষ্ট করবেন না। আর পরিবারকে দুশ্চিন্তায় ফেলবেন না। লিবিয়ার ‘গেমঘর’-এর কষ্ট সহ্য করার মতো নয়। লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তা ও লিবিয়ায় যাওয়া বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমুদ্রপথে ইউরোপ যাওয়ার জন্য লিবিয়া থেকে কাঠের নৌকা ও ফাইবারের নৌকায় যাত্রা করাকে তাদের ভাষায় ‘গেম’ বলে ডাকা হয়।
ইতালি পৌঁছানো মানে গেম জেতা। যাত্রাপথে মারা যাওয়া বা গ্রেফতার হওয়া মানে হেরে যাওয়া। অনেকটা খেলার মতো। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে গেম। অন্যদিকে যে কোনোভাবে লিবিয়া পৌঁছানোর পর শুরু হয় এই গেমে অংশগ্রহণের অপেক্ষা। বাংলাদেশি দালালরা লিবিয়ার দালালদের মাধ্যমে করে এই গেম। অর্থাৎ লিবিয়ার দালালদের নৌকাগুলোই মূলত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়।
নৌকায় ওঠার জন্য চলে নানান দেনদরবার। এ সময়টা রাখা হয় দালালদের আশ্রয়ে। দালালদের এই আশ্রয়গুলোকে বলা হয় গেমঘর। লিবিয়ার উপকূলজুড়ে গেমঘরগুলোতে থাকাদের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও এগুলোতে এ মুহুর্তে অন্যান্য দেশের নাগরিকদের সঙ্গে পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশি আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব গেমঘরে ঢোকে না দিনের আলো। নেই বাতাস চলাচল। গরমে সিদ্ধ হওয়ার দশা হয়।
তিন বেলা খাবার তো জোটে না, পাওয়া যায় না পানিও। খাবার পানি চাইলে জোটে অকথ্য নির্যাতন। দালালদের লাঠির বাড়িতে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে অহরহ। লিবিয়ার জুয়ারা উপকূলে একটি গেমঘরে তিন মাসের মতো বন্দীদশায় থাকা মাদারীপুরের লোকমান বলেন, দালালের মিথ্যা প্রলোভনে পা দিয়ে কত বড় যে ভুল হয় তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায় গেমঘরের প্রথম দিন। খেতে হয় শুকনো শক্ত রুটি।
সেটাও পাওয়া যায় না অনেক দিন। ঘুমাতে হয় ফ্লোরে বালিশ ছাড়া। একজনের সঙ্গে আরেকজনের এক ইঞ্চিও গ্যাপ দেওয়ার সুযোগ নেই, কারণ একটি ১০ ফুট বাই ১০ ফুট ঘরে ২০-২২ জন ঘুমাতে হয়। একসময় গেমঘরে কয়েক মাস কাটানো হাসান মাহমুদ বলেন, স্বপ্ন দেখা উচিত।
তবে স্বপ্ন পূরণের জন্য মরে যাওয়ার চেয়ে বেঁচে থাকা প্রয়োজন। ইতালি যেমন আগের ইতালি নেই, ঠিক তেমনি লিবিয়াও আর আগের লিবিয়া নেই। জাহান্নামের ভিতর ভালো কিছু আশা করা যেমন বোকামি ঠিক তেমনি লিবিয়াতে ভালো কিছু আশা করা বোকামি। অভিভাবকদের বলছি, সন্তানের স্বপ্ন পূরণ করার ক্ষেত্রে বাবা-মার যতটুকু কর্তব্য এটা অবশ্যই করুন, কিন্তু মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে নয়।