চলে গেলেন খ্যাতিমান ব্যবসায়ী, দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট সমাজসেবী, শিক্ষানুরাগী, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন সিকদার গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এর মাধ্যমে দেশ একজন বরেণ্য শিল্পপতিকে হারাল।
সর্বজনশ্রদ্ধেয় শীর্ষ এই ব্যবসায়ী ছিলেন দেশ-বিদেশের অনেক ব্যবসায়ীর জন্যই আদর্শের মূর্ত প্রতীক। কারও কারও কাছে ছিলেন অনুকরণীয়। সিকদার গ্রুপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম বুলবুল গণমাধ্যমকে গতকাল রাতে জানান, জয়নুল হক সিকদারের লাশ দেশে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
বড় ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্নটা দেখেছিলেন স্কুলজীবন থেকেই। এ জন্যই সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ১০০ টাকার পুঁজি নিয়ে শখের বশে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সে সময় ছিল ব্রিটিশ আমল। এরপর পাকিস্তান আমলেও করেছেন বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজ। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনতা যুুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীনের পর আবারও ফিরেছেন ব্যবসায়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সেনাবাহিনীতেও চাকরি করেছেন এক যুগের বেশি সময়। কিন্তু ব্যবসাকে তিনি ভুলে যাননি। ফলে চাকরি ছেড়ে আবারও নেমে যান ব্যবসার কাজে। কারণ নিজের কর্মসংস্থান ও রোজগারের চেয়ে দেশের মানুষের কর্মসংস্থান আর আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনকেই তিনি বড় করে দেখতেন।
দেশকে শত্রুমুক্ত করতে নিজের জীবনের মায়া না করে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে তিনিই একমাত্র রায়েরবাজারে কুলখানির আয়োজন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে। নৈতিকতার প্রশ্নে কখনই আপস করতেন না। তিনি এটাই বিশ্বাস করতেন, নীতি-নৈতিকতা আর একাগ্রতাই ব্যবসার মূলমন্ত্র। আর এটাই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে অনন্য উচ্চতায়।
বর্ণাঢ্য ব্যবসায়িক জীবনে পেয়েছেন নানা খ্যাতি। গড়ে তুলেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপ সিকদার গ্রুপ অব কোম্পানিজ। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন অন্তত ২০ হাজার মানুষের। ছিলেন বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান। ৯১ বছর বয়সে গতকাল দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। পৃথক শোক বাণীতে তাঁরা জয়নুল হক সিকদারের রুহের মাগফিরাত কামনা করার পাশাপাশি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
সফল এই ব্যবসায়ী দেশের অর্থনীতির বিকাশ ও কর্মসংস্থানে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। একে একে ব্যাংক, গার্মেন্ট, রিয়েল এস্টেট, এভিয়েশনসহ বিভিন্ন সেক্টরে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে- তারাও সবাই এখন দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বর্তমানে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইউএই, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকায় সিকদার গ্রুপের ব্যবসা রয়েছে। মোটাদাগে রিয়েল এস্টেট, চিকিৎসা ও শিক্ষা, ব্যাংকিং, এভিয়েশন, আবাসিক হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও গার্মেন্ট সেক্টরে তাঁর ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে সফলতার সঙ্গে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক ও থাইল্যান্ডের ব্যাংককে সিকদার গ্রুপের ‘কই হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ বিশ্বখ্যাত। সিকদার গ্রুপ খুলনার মোংলায় ২০৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করেছে দেশের প্রথম পাবলিক-প্রাইভেট ইকোনমিক জোন। এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত সিকদার রি-রোলিং মিলস এখন সবার চেনা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বান্দরবানে ২০ একর জমির ওপর হচ্ছে চন্দ্রপাহাড় রিসোর্ট। কক্সবাজারে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরিজম ভিলেজ। আবাসন ব্যবসার আওতায় ১০ মিলিয়ন টাকা ব্যয়ে ধানমন্ডিতে নির্মাণ করেছেন সুবিশাল রিভার প্রজেক্ট। নিভৃতচারী আর প্রচারবিমুখ এই শিল্পোদ্যোক্তা গড়ে তুলেছেন সমৃদ্ধ এক শিল্পগোষ্ঠী।
সিকদার গ্রুপ অব কোম্পানিজের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ‘আমরা গভীর শোক ও দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, দেশের অন্যতম বৃহত্তম এবং ঐতিহ্যবাহী শিল্পপরিবার সিকদার গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার গতকাল বুধবার ১০ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।’
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের উজ্জ্বলতম শিল্পোদ্যোক্তা জয়নুল হক সিকদার ১৯৩০ সালের ১২ আগস্ট আসামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে চলে আসেন। জয়নুল হক সিকদার বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার অন্যতম অংশীদার হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। দীর্ঘ সাত দশকের বেশি সময় ধরে তিনি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, পর্যটন, অর্থনীতি, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন খাতে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এবং প্রায় ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন।
শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি তিনি অসংখ্য উদ্যোক্তা গড়ে তুলেছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের অনেকে তাঁদের ব্যবসা শুরুর প্রথম দিকে জয়নুল হক সিকদারের সহায়তা পেয়েছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি ছাড়াও একজন দানশীল মানুষ হিসেবে জয়নুল হক সিকদার বিশেষভাবে সুপরিচিত। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ছাড়াও ব্যক্তিগত আগ্রহে তিনি দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক মানুষের কল্যাণে সহায়তা করেছেন।
জয়নুল হক সিকদার সেই ১৯৪৫ সাল থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে তাঁর পাশে থেকেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার চার দিন পর ১৯ আগস্ট রাজধানীর রায়েরবাজারে কুলখানির আয়োজন করেন তিনি। এ জন্য ওই সময়ের সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা তাঁকে নানাভাবে হয়রানি করে এবং ভয়ভীতি দেখায়, এমনকি তাঁকে জেলও খাটতে হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে বিচার কার্যক্রম শুরু হওয়া পর্যন্ত এই লম্বা সময় জয়নুল হক সিকদার তাঁর প্রিয় ‘মুজিব ভাই’-এর প্রতি ভালোবাসা থেকে খাটে না ঘুমিয়ে ঘরের মেঝেতেই ঘুমাতেন।