ফুটবল মাঠ থেকে বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক

0
101
মহানায়কের জন্ম হলো ফুটবল মাঠ থেকে
মহানায়কের জন্ম হলো ফুটবল মাঠ থেকে

মহানায়কের জন্ম হলো ফুটবল মাঠ থেকে। বাঙালির মুক্তির মহানায়ক। যার বজ্রকণ্ঠের হুঙ্কারে পুরো বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-সংগ্রামের পর ছিনিয়ে এনেছিল লাল-সবুজের স্বাধীনতা।

সেই মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সহজাত নেতৃত্ব’ গড়ে উঠেছিল কিন্তু ফুটবল মাঠ থেকেই। কারো অজানা নয় যে, বঙ্গবন্ধু ফুটবলার ছিলেন। কিন্তু এটা হয়তো অনেকেরই জানা নেই, ফুটবল মাঠ থেকেই প্রস্ফুটিত হয়েছিলো বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারি, অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতিভা।

রাজনীতিবিদ না হলে হয়তো বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হতো একজন সাবেক ফুটবল স্ট্রাইকার হিসেবে। জাঁদরেল স্ট্রাইকারই ছিলেন। ছিলেন ফুটবল মাঠের নেতা। তার নেতৃত্বেই গোপালগঞ্জের মিশন স্কুল দল খেলতো মাঠে। তার নেতৃত্বেই ঢাকায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ওয়ান্ডারার্স ক্লাব।

ফুটবল মাঠের সেই নেতৃত্ব সঞ্চারিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পুরো দেহ-মনজুড়ে। তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে বাঙালি জাতির নিগৃহীত মানুষের মুখচ্ছবি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ-নিপীড়ন দেখে সহ্য হয়নি বঙ্গবন্ধুর।

ফুটবলার হলেও স্কুল জীবনে রাজনীতিতে হাতেখড়ি, রক্তে মিশে গিয়েছিল রাজনীতি। যে কারণে ফুটবল মাঠের সবুজ গালিচা আর বঙ্গবন্ধুকে আটকে রাখেনি, পুরো বাংলাদেশের মুক্তির জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। তবে, নেতৃত্বের যে পাঠ ফুটবল মাঠে পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, তাতে তিনি হয়েছিলেন আরও পরিণত। ফুটবলের ময়দান ছেড়ে রাজনীতির ময়দানে আসার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল বাংলাদেশ।

ছোটবেলা থেকে অন্য দশ কিশোরের মতো খেলার মাঠকেই বেশি ভালবাসতেন বঙ্গবন্ধু। যে কারণে প্রিয় ফুটবল নিয়ে দুরন্তপনায় মেতে উঠতেন। কৈশোরে ফুটবলার হিসেবে তার খ্যাতির কোন ঘাটতি ছিল না। প্রতিযোগিতামূলত ফুটবল আসরের তিনি ছিলেন নিয়মিত এক কুশীলব। ভাল ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে কৈশোরে পুরস্কারও পেয়েছেন।

গোপালগঞ্জে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকতে ফুটবল ও ভলিবল খেলতেন। তৎকালীন মহকুমা টিমেও খেলার রেকর্ড রয়েছে তার। মূলতঃ পারিবারিকভাবেই বঙ্গবন্ধু খেলাধুলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন একজন ফুটবলার। পেশায় তিনি গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন। তবে গোপালগঞ্জের প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টগুলোতে নিয়মিত ফুটবল খেলতেন। গোপালগঞ্জ অফিসার্স ক্লাব দলটির অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করতেন লুৎফর রহমান। অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।

স্কুলে পড়া অবস্থায় ফুটবলে হাতেখড়ি হয় বঙ্গবন্ধুর। ১৯৩৭ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই গড়ে উঠেছিল মিশন স্কুলের ফুটবল দল। স্কুল দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। স্কুল দলের হয়ে বাবার বিপক্ষে বেশ কয়েকটি ফুটবল ম্যাচ খেলেছেন বঙ্গবন্ধু। গোপালগঞ্জ অফিসার্স ক্লাবের বিপক্ষে ৫টি ড্র আছে শেখ মুজিবুর রহমানের দল মিশন স্কুলের, যা তিনি নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। উৎসুক জনসাধারণ বাবার বিপক্ষে তার খেলা বেশ উপভোগ করতেন।

বাবার বিপক্ষে খেলা এবং নিজের ফুটবলস্মৃতি নিয়ে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমার আব্বাও ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। আমি মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। আব্বার টিম আর আমার টিমের যখন খেলা হতো, তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করত। আমাদের স্কুল টিম খুব ভালো ছিল। মহকুমায় যারা ভালো খেলোয়াড় ছিল, তাদের এনে ভর্তি করতাম এবং বেতন ফ্রি করে দিতাম। ১৯৪০ সালে আব্বার টিমকে আমার স্কুল টিম প্রায় সকল খেলায় পরাজিত করল। অফিসার্স ক্লাবের টাকার অভাব ছিল না। খেলোয়াড়দের বাইরে থেকে আনত। সবাই নামকরা খেলোয়াড়।’

কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়া অবস্থায় তিনি কলকাতার বিখ্যাত দুই ক্লাব এরিয়ান্স ও মোহামেডানে খেলার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। দেশে ফিরে তিনি ঢাকার একটি শৌখিন ক্লাবে কিছুদিন খেলে ১৯৪০ সালের শুরুর দিকে যোগ দেন ঐতিহ্যবাহী ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে।

সাবেক খ্যাতনামা ফুটবলার গজনবী বঙ্গবন্ধুর খেলা নিজ চোখে দেখেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন রাজনীতিতে ব্যস্ততার কারণে বঙ্গবন্ধু বেশিদিন খেলতে পারেননি। যদি খেলতেন তিনি চল্লিশ দশকে এশিয়ার অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার হতে পারতেন।

বঙ্গবন্ধু খেলতেন স্ট্রাইকার পজিশনে। তিনি ছিলেন প্রতিপক্ষের আতঙ্ক। বঙ্গবন্ধু বল পাওয়া মানেই নিশ্চিত গোল। তার শটে এতটা পাওয়ার ছিল যে গোলপোস্টের জাল অনেক সময় ছিঁড়ে যেত। হ্যাটট্রিকও করেছেন বেশ কয়েকটি ম্যাচে। ঢাকা প্রথম বিভাগ লিগের যাত্রা হয় ১৯৪৮ সালে। রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকায় বঙ্গবন্ধুর সেভাবে লিগ খেলা সম্ভব হয়নি। তার আগে অবশ্য অসংখ্য টুর্নামেন্ট খেলেছেন।

ওয়ান্ডারার্সের হয়ে ১৯৪৩-৪৪ মৌসুমে বগুড়ায় আয়োজিত গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে তার নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। ওই ম্যাচে ফাইনালে ওয়ান্ডারার্স ৫-০ গোলে জয়ী হয়। তখনকার ৭০ মিনিটের ম্যাচে প্রথমার্ধেই বঙ্গবন্ধুর দেওয়া অসাধারণ ২ গোলে ওয়াল্ডারার্স এগিয়ে থাকে। দ্বিতীয়ার্ধে তিনটি গোল হয় তার নিখুঁত পাসে। টুর্নামেন্টে সেরা ফুটবলারের পুরস্কার পান বঙ্গবন্ধু। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে প্রথম দিকে ৯ ও পরে ১০ নম্বর জার্সি পরে খেলেছেন বঙ্গবন্ধু।

সে সময় দেশের সেরা ফুটবলাররাই ওয়ান্ডারার্সে খেলার সুযোগ পেতেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৪০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত টানা আট বছর ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের জার্সি গায়ে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলেছেন।

পুরান ঢাকার কলতাবাজার ও চকবাজারের বাসিন্দারা মিলে ১৯৩৭ সালে গড়ে তোলেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। অল্প দিনের মধ্যেই এটি দেশের জনপ্রিয় ক্লাবে পরিণত হয়। ফুটবল-হকিতে গঠণ করা হয় শক্তিশালী দল।

এই ক্লাবই ১৯৫০, ১৯৫১, ১৯৫৩, ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৬ ও ১৯৬০ সালে ঢাকা ফুটবল লিগের শিরোপা জিতেছিল। পঞ্চাশের দশকে ওয়ান্ডারার্সের টানা চারবার লিগ শিরোপা জেতার রেকর্ড আজও দেশের ফুটবলের এক দুর্দান্ত ইতিহাস হয়ে আছে। তখন ক্লাবটির এমন শক্তিশালী হওয়ার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।

এই ক্লাবের হয়ে ফুটবলের পাশাপাশি ভলিবল, বাস্কেটবল এবং হকিতে মাঠে নেমেছেন তিনি। বেশ কিছুদিন ক্লাবটির সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। এছাড়া ধানমন্ডি ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় বঙ্গবন্ধুর খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি ঘটে যায়। তার বাকি জীবনের কথা তো ইতিহাস। ধীরে ধীরে নিজের মেধা আর যোগ্যতা দিয়ে হয়ে ওঠেন বাঙালির মুক্তির পথপ্রদর্শক, অবিসংবাদিত নেতা। বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলে ঘুমন্ত বাঙালিকে তিনিই উদ্বুদ্ধ করেন স্বাধীনতাসংগ্রামে।

স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর খেলাধুলার প্রতি যারপরনাই ভালবাসা ছিল তার। খেলোয়াড়রা তার সামনে পড়লেই দারুণ অনুপ্রেরণায় বলে উঠতেন- ‘ভাল খেলতে হবে কিন্তু। দেশের মান রাখতে হবে।’

ক্রীড়াপাগল বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশেও খেলাধুলাকে ভুলে থাকেননি। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গঠন করেন জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। যা বর্তমানে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এটি শিক্ষা-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলেও বর্তমানে সংস্থাটি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রনালয়ের অধীনস্থ। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের ৪৩টি ভিন্ন ভিন্ন ক্রীড়া সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

১৯৭২ সালেই দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) গঠন করেন বঙ্গবন্ধু। ঠিক দু’বছর পরই বাফুফে পেয়ে যায় ফিফা ও এএফসির সদস্যপদ। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিবি) যা বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) নামে পরিচিত, এটাও ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু।

ফুটবল, ক্রিকেটের পাশাপাশি অন্যান্য খেলাগুলোকেও সমান প্রাধান্য দিতেন বঙ্গবন্ধু। ক্রীড়ার মান উন্নয়নে অবকাঠামোর সুবিধাদি এবং সঠিক প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে বিশেষ ধরণের একটি প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে লক্ষ্যে তিনি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় প্রকল্প আকারে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব স্পোর্টস (বিআইএস) প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন।

১৯৮৩ সালে বিআইএস সরকারী থেকে স্বায়ত্বশাসিত ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন এর নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৪ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়।