আজ শুক্রবার(২০ আগস্ট) পবিত্র আশুরা। কারবালার শোকাবহ ও হৃদয়বিদারক ঘটনার এই দিনটি ধর্মীয়ভাবে বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও শোকাবহ একটি দিন। মুসলিমবিশ্বে ত্যাগ ও শোকের প্রতীকের পাশাপাশি পবিত্র দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনটি হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখ। আরবি ‘আশারা’ শব্দের অর্থ দশ।
বিশ্বের বিভিন্ন জাতির ইতিহাস কিভাবে এ দিনের সঙ্গে জড়িত তার প্রতি দৃষ্টি দিলে সহজেই আমরা আশুরার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি। মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদমকে (আ.) প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি, জান্নাতে অবস্থান, পৃথিবীতে প্রেরণ ও তওবা কবুল সবই আশুরার তারিখে সংঘটিত হয়।
হজরত নূহ (আ.) সাড়ে ৯শ’ বছর তাওহিদের দাওয়াত দেওয়ার পরও যখন পথভ্রষ্ট জাতি আল্লাহর বিধান মানতে অস্বীকৃতি জানায়; তখন তাদের প্রতি নেমে আসে আল্লাহর গজব মহাপ্লাবন। এই মহাপ্লাবনের ধ্বংসলীলা থেকে রক্ষা পায় তারা যারা আল্লাহ ও নবীর প্রতি বিশ্বাসী হয়ে হজরত নূহের (আ.) নৌকায় আরোহণ করে। ওই নৌকা ৪০ দিন পর জুদি পাহাড়ের পাদদেশে মাটি স্পর্শ করে ঐতিহাসিক আশুরার দিন।
এ দিনেই হজরত ইবরাহিমের (আ.) জন্ম, ‘খলিলুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত ও নমরুদের অগ্নি থেকে রক্ষা পান। হজরত ইদরিসকে (আ.) বিশেষ মর্যাদায় চতুর্থ আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয় আশুরার দিনে। সুদীর্ঘ ৪০ বছর পর হজরত ইউসুফের (আ.) সঙ্গে তার পিতা হজরত ইয়াকুবের (আ.) সাক্ষাৎ যেদিন হয়- সে দিনটি ছিল আশুরার দিন।
কারবালার ইতিহাস
ইতিহাসে উল্লেখ আছে, ইসলামের সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন দামেস্ক অধিপতি মাবিয়ার পুত্র এজিদের খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে কারবালা প্রান্তরে হৃদয় বিদারক হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়।
মহররম পর্বের বিষয়বস্তু হলো ইমাম হাসানের সাথে এজিদের বিরোধ, ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা ও কারবালায় ইমাম হুসাইনকে হত্যা।
এর ইতিহাসে লেখা হয়েছে, আবদুল জব্বারের স্ত্রীর নাম জয়নাব। খুবই রূপবতী। মু‘আবিয়ার পুত্র ইয়াযীদ তাকে দেখে মুগ্ধ হয় এবং তাকে বিয়ে করতে চায়। ইয়াযীদের মা মারওয়ানের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং প্রলোভন দেখিয়ে জয়নাবের সঙ্গে আবদুল জব্বারের বিচ্ছেদের ব্যবস্থা করে।
আবদুল জব্বার জয়নাবকে তালাক দেয়। এরপর ইয়াযীদ জয়নাবের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দূত পাঠায়। পথে এ দূতের সঙ্গে ইমাম হাসানের সাক্ষাৎ হয়। ইমাম হাসান জয়নাবের কাছে তার পক্ষ থেকেও বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য দূতকে অনুরোধ করেন।
জয়নাব ইয়াযীদের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে এবং ইমাম হাসানের প্রস্তাব গ্রহণ করে। ইমাম হাসান জয়নাবকে বিয়ে করেন। ইয়াযীদ ক্রোধে ফেটে পড়ে। অন্যদিকে ইমাম হাসানের অপর স্ত্রী জায়েদা জয়নাবকে হিংসা করতে শুরু করে।
এর মধ্যে মু‘আবিয়া অসুস্থ হয়ে মারা যান। ইয়াযীদ বাদশাহ হয়। সে মদিনার অধিবাসীদের তার আনুগত্য স্বীকার করার নির্দেশ দেয়। মদিনার অধিবাসীরা তা অস্বীকার করলে ইয়াযীদ মারওয়ানকে মদিনা আক্রমণের জন্য পাঠায়।
মদিনার সেনাদলের সঙ্গে মারওয়ানের সেনাদলের যুদ্ধ হয় এবং মারওয়ান পরাজিত হয়। পরে মারওয়ান মায়মুনা নামের এক বৃদ্ধার সাথে ইমাম হাসানকে হত্যার ব্যাপারে ষড়যন্ত্র করে। মায়মুনা ইমাম হাসানের স্ত্রী জায়েদার মাধ্যমে বিষ প্রয়োগে ইমাম হাসানকে হত্যা করে। ইমাম হুসাইন এ হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
এদিকে কুফার শাসক উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ (আবদুল্লাহ জেয়াদ) ধোঁকা দিয়ে ইমাম হুসাইনকে বন্দি করার জন্য বাহ্যিকভাবে ইমাম হুসাইনকে নেতা বলে স্বীকার করে এবং তাকে কুফায় আসার আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠায়।
ইমাম হুসাইন কুফার অবস্থা যাচাইয়ের জন্য মুসলিম ইবনে আকীলকে পাঠান। মুসলিম কুফার ব্যাপারে ইতিবাচক পত্র পাঠানোর পর ইমাম ছয় হাজার সৈন্য নিয়ে কুফার দিকে রওয়ানা হন। পথে তিনি মুসলিমের শাহাদাতের খবর পান।
মুহররম মাসের আট তারিখে ইমাম হুসাইন কারবালার প্রান্তরে পৌঁছেন। এখানে ইয়াযীদের সেনাবাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ হন। তারা ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দেয়। ইমামের পরিবার ও সাথীরা ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে পড়েন।
এ অবস্থার মধ্যেও ইমাম হুসাইন তার মেয়ে সাকীনার সাথে ইমাম হাসানের ছেলে কাসেমের বিয়ে দেন। অবশেষে মুহররমের ১০ তারিখে ইয়াযীদের সেনাদলের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ইমাম হুসাইন তার সব সঙ্গী-সাথীসহ শাহাদাত বরণ করেন।
কারবালা প্রান্তরের এ বিয়োগাত্মক ঘটনা বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন যায়গায় বিভিন্ন ভাবে উঠে এসেছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার মহররম কবিতায় আশুরার দিনের সে ঘটনাকে তুলে ধরেছেন—
‘নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া –
আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া,
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে?
সে কাঁদনে আসু আনে সিমারের ও ছোরাতে।
রুদ্র মাতম ওঠে দুনিয়া দামেস্কে –
জয়নালে পরালো এ খুনিয়ারা বেশ কে ?
হায় হায় হোসেনা ওঠে রোল ঝঞ্ঝায়,
তলোয়ার কেঁপে ওঠে এজিদের পাঞ্জায়
উন্ মাদ দুল দুল ছুটে ফেরে মদিনায়
আলীজাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায়।’
যেভাবে উদযাপিত হয় আশুরা
ইহুদিরা আশুরা উপলক্ষে মুহররম মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখে। শিয়া সম্প্রদায় মর্সিয়া ও মাতমের মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপন করে। আশুরা উপলক্ষে ৯ ও ১০ মুহররম তারিখে অথবা ১০ এবং ১১ রোজা মুহররম তারিখে রাখা মুলমানদের জন্য সুন্নাত। এছাড়া মুসলমানরা এদিন উত্তম আহারের জন্য চেষ্টা করে থাকে।
কারবালার শিক্ষা
আশুরার দিন কারবালা প্রান্তরে মানব ইতিহাসের যে নির্মম কাহিনী রচিত হয়েছিল তা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তাদের মজবুত ঈমান। তাই আমাদের ঈমানি চেতনায় বলীয়ান হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জীবন পরিচালনা করতে হবে।
কারবালার প্রান্তরে হজরত হুসাইন (রা.) সপরিবারে আত্মত্যাগ করে সমগ্র বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন, যে মস্তক আল্লাহর কাছে নত হয়েছে সে মস্তক কখনও বাতিল শক্তির কাছে নত হতে পারে না। আল্লাহর পথে অটল থাকতে মুমিনরা তাদের জীবনকে উৎসর্গ করতে দ্বিধা করে না। তাই আজকের মুসলমানরা সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শপথ নিতে পারলেই কেবল আশুরার তাত্পর্য