
ধান-চাল সংগ্রহে চলতি বছরে বড় ধরনের হোঁচট খেলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটু একটু করে সরকারের মজুদ বেড়েছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় কম। এ দুর্বলতার কারণে বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। ব্যবসায়ীদের হাতে বাজার জিম্মি হয়ে পড়ছে। চলতি বছরের সংকটময় পরিস্থিতি বিশ্নেষণ করে সরকারি মজুদের পরিমাণ বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ করার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বাজার ও কৃষিসংশ্নিষ্ট গবেষকরা।
এই বিশেষজ্ঞরা প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের সঙ্গে তুলনা করে দেশের প্রধান খাদ্যশস্যের দাম নাগালে রাখতে নতুন কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার সুপারিশ করেছেন। চাল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও উৎপাদন প্রায় সমান সমান। কোনো বছর সামান্য রপ্তানি হয়, আমদানিও করতে হয়। কিন্তু সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ ও মজুদ কার্যক্রমের দুর্বলতায় একদিকে উৎপাদক কৃষক ন্যায্য দাম পান না, অন্যদিকে কৃষকসহ মধ্যবিত্তদের বেশি দামে কিনে খেতে হয়। বেশি মুনাফা করে মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে চালের চাহিদার মাত্র ৬ শতাংশ সংগ্রহ করছে সরকার। সেটা প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ টন।
বছরে ৫০ লাখ টন ধান কিনে সরকারের আপৎকালীন মজুদ করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রতিবেশী দেশের মতো নিবন্ধন পদ্ধতিতে কৃষকদের থেকে সরাসরি ধান কিনতে হবে। মিলারদের মাধ্যমে চাল প্রক্রিয়া করে সংরক্ষণের কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সাধারণ মানুষের ন্যায্যমূল্যে চাল কেনার সুযোগ নিশ্চিত করতে রেশন কার্ড বা নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানিয়েছেন, সরকার আরও মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য গুদাম নির্মাণ করা হচ্ছে। তথ্য পর্যালোচনায় জানা যায়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে সাড়ে ছয় কোটি কম। বাঙালি অধ্যুষিত এই রাজ্য বছরে এ দেশের প্রায় দ্বিগুণ ধান কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে। নেপালের জনসংখ্যা বাংলাদেশের চার ভাগের এক ভাগ হলেও সেখানে ১৫ লাখ টন ধান কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কেনা হয়। আর শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যা বাংলাদেশের আট ভাগের এক ভাগ হলেও ওই তুলনায় কৃষকদের কাছ থেকে অনেক বেশি ধান কেনে।
সম্প্রতি দেশে ধান-চালের উৎপাদন কোনো কোনো বছর চাহিদার চেয়ে বেশি হয়েছিল। সরকার রপ্তানির পরিকল্পনা করেছিল। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কোনো কোনো বছর উৎপাদনে ঘাটতি হয়েছে। গত বছর তেমন গেছে। সরকারের মজুদ কম থাকায় বাজার অস্থির হয়ে পড়ে। চুক্তি করেও ব্যবসায়ীরা সরকারকে চাল দেয়নি। বাজারে সরবরাহের ক্ষেত্রেও তারা কৌশল নিয়েছে। ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
বাজার অর্থনীতিতেও ব্যবসায়ীদের অনৈতিক কারসাজির মুখে সরকার যাতে জনস্বার্থে, বিশেষ করে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের স্বার্থে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে পারে, সে জন্য সরকারের হাতে পর্যাপ্ত মজুদ থাকা উচিত বলে মনে করেন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, সঠিক কৌশলে মজুদ চালের বিতরণ বাড়িয়ে বাজার স্থিতিশীল করতে হয়। কিন্তু সরকারের সে সক্ষমতা থাকে না।
এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ ও মজুদ বাড়ানোর পরিকল্পনায় আরও গুদাম নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এখন প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে লটারির মাধ্যমে এবং কৃষক অ্যাপের মাধ্যমে ধান কেনা হচ্ছে, যা ভারতেও নেই। তবে ভারতে পূর্ণাঙ্গ রেশনিং ব্যবস্থা চালু আছে। আমাদের দেশে আংশিক রেশনিং আছে।
এ ছাড়া হতদরিদ্রদের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি আছে; কাবিখা, টিআর, ভিজিডি, ভিজিএফ, জিআরসহ অন্যান্য ব্যবস্থা চালু আছে। এখন এগুলো অ্যাপসের মাধ্যমে করার চেষ্টা চলছে। তাতে প্রক্রিয়া আরও সহজ হবে। মন্ত্রী বলেন, সরকার যে পরিমাণ ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে, কৃষকরা তা সরবরাহ করেনি। কারণ, বাজারে ভালো দাম পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের কথা :বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন সমকালকে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ৪০ লাখ টন চাল মজুদ করা উচিত। পশ্চিমবঙ্গের মতো কৃষকদের নিবন্ধন করে সরাসরি ধান কিনতে হবে। এখন মিল থেকে কেনায় মিলাররা গেম খেলছেন। জরুরি প্রয়োজনে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এখন অনলাইন প্রক্রিয়ায় যাওয়া দরকার।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ধান-চালের ক্ষেত্রে তিনটি জায়গায় নজর দেওয়ার সময় এসেছে। প্রথমত, ভোগের চাহিদার পুনঃমূল্যায়ন প্রয়োজন। উৎপাদন, মজুদ ও বিতরণের সুনির্দিষ্ট হিসাব করা দরকার। এ হিসাবে ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ধান-চাল সংগ্রহ প্রক্রিয়া ত্রুটিযুক্ত। এ ক্ষেত্রে সরকারের দুর্বলতা আছে। তৃতীয়ত, বাজার স্থিতিশীল রাখতে সমস্যা হলেই সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে খাদ্য, বাণিজ্যসহ আটটি মন্ত্রণালয় জড়িত। সবাইকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।


