নবজাতক শিশুর অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ, অপরিণত বয়সে এবং কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ। প্রতি বছর বাংলাদেশে ৫ লাখ ৭৩ হাজার নবজাতক সময়ের আগে অর্থাৎ অপরিণত বয়সে জন্ম নেয়। ৮ লাখ ৩৪ হাজার নবজাতক জন্মায় কম ওজন নিয়ে। এদের মধ্যে ১ লাখ ৯২ হাজার নবজাতকের জন্মকালীন ওজন হয় ২ কেজির নিচে। ফলে দেশে প্রতি বছর ১৭ হাজার ১০০ নবজাতক এই দুইয়ের সম্মিলিত কারণে মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে ৭২ শতাংশ নবজাতক মারা যায় জন্মের প্রথম দিনে, সচেতন হলে যা কমিয়ে আনা সম্ভব।
গতকাল বুধবার সকালে রাজধানী মহাখালীর আইসিডিডিআরবি কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশে অকালজাত জন্ম ও জন্মকালীন কম ওজনের সমস্যা, সমাধান ও উত্তরণের উপায়’ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এসব তথ্য জানান। এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে আইসিডিডিআর,বি’র রিসার্চ ফর ডিসিশন মেকারস (আরডিএম) প্রকল্প ও ডাটা ফর ইম্প্যাক্ট (ডিফরআই)। ওই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে ইউএসএআইডি।
সভায় মূল প্রতিবেদন উপস্থাপনাকালে আইসিডিডিআর,বি’র অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট ডা. আহমেদ এহসানুর রহমান জানান, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফি হেলথ সার্ভে-বিডিএইচএস ২০১৭-১৮ সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, শিশু মৃত্যুর হার পূর্বের ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরে আসছে। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া প্রতি হাজার নবজাতকের মধ্যে ৩০ শিশুর মৃত্যু হয়। যাদের মধ্যে ১৯ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যু হয় অপরিণত বয়সে জন্মানো (প্রিম্যাচিওর বার্থ) এবং কম ওজন (লো বার্থ ওয়েট) নিয়ে জন্মানোর কারণে।
ডা. আহমেদ এহসান আরো বলেন, প্রতি বছর এই ১৭ হাজার ১০০ নবজাতক মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ পরিবার কোন ধরনের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করে না। অন্যদিকে ৪৩ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যু ঘটে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। নবজাতকের জন্মকালীন ওজন নির্ণয়ের মাধ্যমে তাকে কম ওজনের হিসেবে চিহ্নিত করার যে পদ্ধতি, তার প্রস্তুতি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত নেই।
বাংলাদেশ হেলথ ফ্যাসিলিটি সার্ভে-২০১৭ অনুযায়ী, দেশের মাত্র ৬৯ শতাংশ জেলা হাসপাতাল এবং ৬৫ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই ওজন পরিমাপক স্কেল আছে। দেশের মাত্র ২০০ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কেএমসি (ক্যাংগারু মাদার কেয়ার) সেবা প্রদানের ব্যবস্থা আছে, যেখানে সীমিত সংখ্যক কম ওজনসম্পন্ন নবজাতক সেবা পাচ্ছে। কেএমসি প্রদানের গুণগতমান, ফলো আপ সুবিধার অপর্যাপ্ততা এবং কম সময় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অবস্থানের প্রবণতাও সমীক্ষায় উঠে আসে। ২০২০ সালে মাত্র ৫ হাজার ৭৩১ জন নবজাতক কেএমসি সেবা লাভ করে, যা সেবা প্রয়োজন এমন নবজাতকের সংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ।
ডা. এহসান বলেন, নবজাতকের মৃত্যু রোধে কেএমসি অত্যন্ত উপযোগী, এটি একটি কম ব্যয়সাপেক্ষ ও সহজ সমাধান। কিন্তু এই পদ্ধতির সঠিক প্রয়োগের জন্য চাই দীর্ঘ সময় শিশুকে মায়ের ত্বকের সংস্পর্শে রেখে সেবা প্রদান ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ। তাই আপাতদৃষ্টিতে এই পদ্ধতি সহজ সমাধান মনে হলেও তা বাস্তবায়নে প্রয়োজন অধিক মনোযোগ।
আইপাস বাংলাদেশের কান্ট্রি প্রধান ডা. সায়েদ রুবায়েত বলেন, কোভিড-১৯ এর মতো মহামারির সময়েও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, উপযুক্ত সাবধানতা অবলম্বন করে কেএমসি প্রদান করলে নবজাতকের জন্য ঝুঁকি তৈরি হয় না। তাই নবজাতকের মৃত্যুরোধে কেএমসিসহ অন্যান্য সেবা সহজলভ্য করার পাশাপাশি এর সুবিধা সম্পর্কে পরিবার ও কমিউনিটিকে অবহিত করতে হবে।
সভায় আরো বক্তব্য রাখেন, নবজাতক স্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মাদ শহীদুল্লাহ। সভা পরিচালনা করেন আইসিডিডিআর,বি’র ম্যাটার্নাল অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ ডিভিশনের সিনিয়র ডিরেক্টর এবং আরডিএম প্রকল্প প্রধান ডা. শামস এল আরেফিন। সভায় উপস্থিত ছিলেন ইউএসএইড বাংলাদেশের সিনিয়র মনিটরিং, ইভ্যালুয়েশন অ্যান্ড রিসার্চ অ্যাডভাইজর ডা. কান্তা জামিল।