জুনের শুরুতে থেকেই দেশের রাজধানী ঢাকায় দেখা যাচ্ছে অতিবৃষ্টি। গত ১ জুন চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে ঢাকায়। এমন ঘটনা ঘটলো বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই। বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে, গত একদশক ধরে বাংলাদেশে বাৎসরিক মোট বৃষ্টিপাত বাড়ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অতিবৃষ্টি আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ! বিশেষজ্ঞরা জানালেন, সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে ভয়ের কিছু নেই। উপরন্তু দেশের চারটি পরিবেশগত সংকটের সমাধানও করতে অতিবৃষ্টি।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের এক নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ছে। আগামী ২০৩০ সালে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১০-১৫ শতাংশ এবং ২০৭৫ সালে প্রায় ২৭ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি ব্রাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্টিভেন ক্লেমেন্সের নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায়ও বলা হয়েছে, ভারতীয় উপমহাদেশে বর্ষা মৌসুম ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে।
মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৫ এবং ২০১৭ সালে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়েছিলো গোটা দেশে। সেসময় বন্যাও দেখা দেয়। পরে ২০২০ সালের বন্যার পেছনেও ছিলো অতিবৃষ্টি। এছাড়া ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে শুধু ২০১৪ সালেই বেশি বৃষ্টিপাত হয়নি।
জানা গেছে, তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে বৃষ্টিপাত বাড়ার একটা সম্পর্ক রয়েছে। আবহাওয়া এবং পরিবেশবিদরা ইত্তেফাক অনলাইনকে জানিয়েছেন, দেশে তাপমাত্রা বাড়ার কারণেই অতিবৃষ্টি হচ্ছে। ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগরে গত কয়েক বছর ধরে তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়েছে। ফলে একটা ব্যতিক্রমধর্মী জলবায়ুগত অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বেশি জলীয় বাষ্প যাচ্ছে বায়ুমণ্ডলে, ফলে বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
তারা আরও জানান, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের স্থানীয় একটি রূপ এই অতিবৃষ্টি। যদি গরমকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধি কমানো যায় তবে বৃষ্টিও সহনীয় মাত্রায় নেমে আসবে। এজন্য দেশে জলাশয় বৃদ্ধি এবং গাছপালা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
তবে বন্যা ও জলাবদ্ধতার বাইরে অতিবৃষ্টির ইতিবাচক দিকগুলোও ইত্তেফাক অনলাইনের সামনে তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের চারটি সংকটের সমাধান হতে পারে ক্রমবর্ধমান বৃষ্টিপাত।
এগুলো হচ্ছে- ক) দেশে রাসায়নিক সারের অপব্যবহারের কারণে মাটির উর্বরতা কমে গেছে। অতিবৃষ্টির বন্যা পলির মাধ্যমে জমির উর্বরতা বাড়াতে সহযোগিতা করে। যদি বন্যায় ফসলের ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায় তাহলে বন্যা পরবর্তী উৎপাদন বৃদ্ধিতে সেই ক্ষতিটা পুষিয়ে যাবে। খ) দেশের বেশিরভাগ নদীর পানি উজান থেকে আসে।
এই অঞ্চলে বৃষ্টি কম হতে হতে এখানকার নদীগুলোর নাব্যতা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদি পর্যাপ্ত পানি আসত তাহলে নাব্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হত না। যেহেতু পানি কম তাই নদীর মাঝে চর জমেছে। বেশি বৃষ্টি হলে এ সমস্যার সমাধান হবে। গ) ঢাকাসহ সারাদেশেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এখন বৃষ্টি বেশি হলে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। ঘ) উজান থেকে পর্যাপ্ত পানি না আসায় শুকনো মৌসুমে স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে না নদ-নদীর পানিপ্রবাহ।
ফলে নদীর পানির বিপুল চাপের কারণে সমুদ্রের লোনাপানি যতটুকু এলাকাজুড়ে আটকে থাকার কথা ততটুকু থাকে না, পানির প্রবাহ কম থাকার কারণে সমুদ্রের লোনাপানি স্থলভাগের কাছাকাছি চলে আসে। ফলে লবণাক্ততা বেড়ে যায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল এলাকায়। ম্যানগ্রোভ অঞ্চল নষ্ট হচ্ছে এবং অস্তিত্ব নিয়ে হুমকিতে পড়েছে বিভিন্ন দেশী প্রজাতির শস্য। বৃষ্টিই এর সমাধান।
পরিবেশবিদ প্রফেসর আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘বৃষ্টির পানি কীভাবে কাজে লাগানো যায় এখন সেই আলোচনা শুরু করা দরকার। আগে দুই/তিন দশক জুড়ে বৃষ্টিপাত দিন দিন কমছিলো। তখন অতিবৃষ্টি নিয়ে কথা আসার সুযোগই ছিলো না। পরে গত প্রায় এক দশক ধরে বৃষ্টিপাত বাড়ছে।’
তিনি উল্লেখ বলেন, ‘অনেক জায়গায় নদী কৃত্রিমভাবে খনন করতে হচ্ছে। এটি খুবই ব্যয়বহুল এবং এটি স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা না। নদী বিজ্ঞানে এই ধরনের খননকাজকে সাপোর্টও করা হয় না। আবার দেখেন নদী খননের জন্য আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হচ্ছে। এখানে একধরনের দুর্নীতিও হয়ে থাকে। মিডিয়া আমরা এসব দেখেছি। বৃষ্টি বাড়লে নদী খনন নিয়ে আর চিন্তার কিছু নেই।