একের পর এক ব্যর্থতায় মানুষ যখন হতাশায় ভুগতে শুরু করেন তখন তাদের সামনে সবচেয়ে সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মানুষটি হচ্ছেন কেএফসির প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল হারল্যান্ড স্যান্ডার্স। বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর সাফল্যের শীর্ষে উঠেছিলেন তিনি.
নাম কর্নেল হারল্যান্ড স্যান্ডার্স। বিশ্বের প্রথম বড় ফ্রাইড চিকেন ‘কেএফসি’র মালিক তিনি। জীবনের শুরু থেকে শেষ অবধি ব্যর্থতা আর গ্লানির মাঝে কাটালেও নিজের অদম্য ইচ্ছা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে ৬০ বছর বয়সে সফলতা লাভ করেন। বর্তমানে ফাস্টফুডের জগতে ম্যাকডোনাল্ডসের পর নিঃসন্দেহে বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত নামটি হলো কেএফসি বা কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন।
বিশ্বের ১২৫টি দেশে ২০ হাজারের বেশি কেএফসির অনুমোদিত আউটলেট রয়েছে। আর এই বিস্তৃত ফাস্টফুড রেস্টুরেন্টের খাবারের মেন্যুতে সবার ওপরে যে নামটি রয়েছে তা হচ্ছে অরিজিনাল রেসিপি চিকেন। ১১ রকমের মসলার মিশ্রণে তৈরি করা এই চিকেন ফ্রাইয়ের মন ভোলানো স্বাদ ছোট-বড় সবাইকে আকৃষ্ট করে। কেএফসির রেসিপি চিকেনও কেএফসির আউটলেটগুলোতে একটি সর্বজনীন অর্ডার। ১৯৪০ সালে কেএফসির প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল হারল্যান্ড প্রথম ১১ রকমের মসলার মিশ্রণে অরিজিনাল রেসিপি চিকেন নামে এই চিকেন ফ্রাই বিক্রি শুরু করেন।
তারপর থেকে এই ভাজা মুরগির স্বাদ বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে যেতে লাগল অবিকৃতভাবে। ২০০৬ সালে বিশ্বজুড়ে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি চিকেন ফ্রাই বিক্রি করার মাইলফলক ছাড়িয়ে যায় কেএফসি! অথচ এই ফ্রাইড চিকেনের জনকের জীবন মসৃণ ছিল না। বারবার ব্যর্থতা গ্রাস করে স্যান্ডার্সের জীবনে। অবশেষে ৬৬ বছর বয়সে তিনি এসে সফলতা পান। পুরো নাম কর্নেল হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডার্স। জš§ ১৮৯০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের হেনরিভ্যালিতে। বাবা উইলবার ডেভিড এবং মা মার্গারেট অ্যানে স্যান্ডার্স। তিন সন্তানের মধ্যে স্যান্ডার্স সবার বড়। বাবা ছিলেন একজন কৃষক। ৮০ একর জমির একটি ফার্মে তিনি কৃষিকাজ করতেন। আর তাতেই সংসারটি কোনো রকমে চলে যেত স্যান্ডার্সদের। কিন্তু হঠাৎ দুর্ঘটনায় স্যান্ডার্সের জীবনের ছন্দপতন ঘটে। ১৮৯৩ সালে ফার্মে কাজ করার সময় দুর্ঘটনায় বাবা উইলবার ডেভিডের পা ভেঙে যায়। দুর্ঘটনার দুই বছর পর যখন স্যান্ডার্সের বয়স মাত্র পাঁচ বছর তখন বাবা উইলবার ডেভিড মারা যান।
বাবার মৃত্যুর পর মা মার্গারেট অ্যানে ১৯০২ সালে আবার বিয়ে করেন। সৎ বাবার পরিবার ভালো লাগত না স্যান্ডার্সের। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর স্যান্ডার্স ও তাদের পরিবার ইন্ডিয়ানার গ্রিনউডে চলে আসেন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান বলে অর্থাভাবে মাত্র ১৩ বছর বয়সে ঘর ছাড়েন। স্কুল থেকে ঝরে পড়েন তারও আগে। শুরু করেন খামারে কৃষকের কাজ। কিন্তু কিশোর বয়সে স্যান্ডার্সের কৃষি কাজ ভালো লাগত না। এরপর ইন্ডিয়ানা পুলিশের ঘোড়ার গাড়ি রং করার চাকরি নেন। এটাও ছেড়ে দিয়ে ১৪ বছর বয়সে আবারও খামারে খেতমজুরের কাজ শুরু করেন।
এরপর ১৯০৬ সালে ইন্ডিয়ানার নিউ আলবানিতে গাড়ির কন্ডাক্টরের চাকরি করেন। মাত্র বছরখানেক করেছিলেন সেই চাকরি। এরপর কামারশালায় লোহা পেটানোর কাজ নেন। কিন্তু এখানেও মন টেকে না স্যান্ডার্সের। এবার কয়লাচালিত ট্রেনের ছাইয়ের টাংকি পরিষ্কারের কাজ শুরু করেন। ১৬ বছর বয়সে কাজ পান স্টেশনের ফায়ারম্যানের। এক সময় নর্থফোক ও ওয়েস্টার্ন রেলস্টেশনে দিনমজুরের কাজও করেন। কর্নেল স্যান্ডার্স এক জায়গায় বেশি দিন কাজ করতে পারতেন না। দুই বছর পর আবার তিনি ফিরে যান ইলিনয় সেন্ট্রাল রেল রোডে। শুরু করেন ফায়ারম্যানের কাজ। ১৭ বছরের মাথায় মোট চারবার চাকরি হারিয়েছিলেন স্যান্ডার্স। এরপর এক্সটেনশন ইউনিভার্সিটিতে আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।
পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে লিটল রক নামের প্রতিষ্ঠানে বছর তিনেক প্রশিক্ষণ শেষে অর্থ উপার্জন শুরু করেন। এখানেও তাঁর বাধার শেষ ছিল না। মাথা গরম প্রকৃতির স্যান্ডার্স ক্লায়েন্টের সঙ্গে আদালতপাড়ায় ঝগড়া করেই আইন পেশার সমাপ্তি ঘটান। অর্থাভাবে কিছু দিন পর নিজে আইন পেশাকে বিদায় জানান। সেখান থেকে ফিরে পেনসিলভেনিয়া। চাকরি নেন রেলস্টেশনে। এখানেও খুব বেশি দিন না থেকে ১৯১৬ সালের দিকে পরিবার নিয়ে জেফারসনভাইলে চলে আসেন এবং বীমা কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন। স্যান্ডার্স কোথাও স্থায়ী হতে পারতেন না। কারণ, তিনি ছিলেন রাগী প্রকৃতির। তাই বীমার চাকরি হারিয়ে সেলসম্যানের কাজ করেন। করেছেন স্টোর ক্লার্কের কাজও। ১৯০৮ সালে ১৮ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন এবং ১৯ বছর বয়সেই বাবা হন। কিন্তু ২০ বছর বয়সে স্ত্রী তাঁকে ফেলে রেখে কন্যাসন্তানটিকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান। ১৯২০ সালে তিনি নৌকার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
স্যান্ডার্স এখানে ডিঙি নৌকা তৈরি করে তা বিক্রি করতেন। এক সময় কোম্পানির ভবিষ্যৎ আরও বড় পরিসরে করার জন্য কোম্পানির নামে শেয়ারও চালু করেন। যার বেশির ভাগ মালিক ছিলেন স্যান্ডার্স নিজেই এবং পরে তিনি কোম্পানির সচিব নির্বাচিত হন। এটিই ছিল ক্যারিয়ারের প্রথম সফলতা। ১৯৪০ সালে ১৪০ আসনের রেস্টুরেন্ট খুলে স্পেশাল ফ্রাইড চিকেন বিক্রি শুরু করেন। নতুন স্বাদের এই চিকেন জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ১৯৫২ সালে স্যান্ডার্স ‘চিকেন ফ্রাই’ ধারণাটিকে আয়ের উৎসে পরিণত করার পর থেকে ‘ক্যান্টাকি ফ্রাইড চিকেন’ বিশ্বের প্রথম বড় ফ্রাইড চিকেন কোম্পানি হয়ে ওঠে। প্রাচীন রেস্তোরাঁটিই আজকের ‘কেএফসি’। যার রয়েছে ৬০০টি শাখা। ১৯৭০ সালে স্যান্ডার্স আমেরিকান কোম্পানির কাছে রেস্তোরাঁটি ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করেন।
১৯৮০ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্যান্ডার্স ছুটে বেড়িয়েছেন মাইলের পর মাইল তাঁর হাতে গড়া রেসিপির কদর আর মান দেখার জন্য। কখনো গুণাগুণের ব্যাপারে সমঝোতা করেননি। সব সময় চেয়েছেন নিজের তৈরি রেসিপি নিয়ে মানুষের মনে বেঁচে থাকতে। তাঁর চাওয়া যে সফলভাবে পাওয়াতে পরিণত হয়েছে তা তো সময়ই প্রমাণ। তাই মন থেকে কিছু চেয়ে সঠিকভাবে লেগে থাকলে সফলতা আসবেই। যে কোনো বয়সে নতুন উদ্দীপনায় নতুন কৌশলে নিজেকে জাহির করাই ছিল স্যান্ডার্সের আদর্শ।