খেলাপির ‘অভিশাপ’ থেকে মুক্ত হতে চলছে ঋণ অবলোপন

0
34
ঋণ অবলোপন
ঋণ অবলোপন

ব্যালেন্স শিট বা স্থিতিপত্রকে খেলাপি ঋণের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো প্রতিনিয়ত ঋণ অবলোপন (রাইট অফ) করছে। অনেকটা আদায়ের আশা ছেড়ে দিয়েই এ বিশেষ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে।

২০২০ সালে অবলোপনের মাধ্যমে ছয় হাজার ৫৯০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ব্যালেন্স শিট থেকে বাদ দেয়া হয়, যা তার আগের বছরের (২০১৯ সাল) তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি। ২০১৯ সালে ব্যাংক অবলোপনের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। এর বিপরীতে (অবলোপনকৃত থেকে) আদায়ের হার ছিল এক শতাংশের নিচে।

দীর্ঘদিন ব্যাংক ব্যবস্থায় থাকা মন্দমানের (কু-ঋণ) খেলাপি ঋণ আর্থিক বিবরণী (ব্যালেন্স শিট) থেকে বাদ দেয়াকে ‘ঋণ অবলোপন’ বলে। ব্যাংকের মূল হিসাবে খেলাপি ঋণ কম দেখাতেই এ ধরনের ছাড় দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়ে থাকে।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদায়ের আশা ছেড়ে দিয়েই প্রতিনিয়ত ঋণ অবলোপনের আত্মঘাতী ফাঁদ তৈরি করা হচ্ছে। এতে ব্যাংক খাতের অবস্থা বেহাল হয়ে যায়। অন্যদিকে ঋণ আদায়ের করুণ দশা জেনেও ব্যাংকগুলোকে নীতি সহায়তা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার জন্যেও ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত সময় দেয়া হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই এ সুবিধাটি নিয়ে আসছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ছাড়াও বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংকসহ প্রভিশন সংরক্ষণের অতিরিক্ত সময় নিয়েছে আরও কয়েকটি ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ) অবলোপন থেকে আদায়ের হার মাত্র ০.৩৩ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-মে-জুন) ০.১১ শতাংশ, তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর) ০.২৭ এবং চতুর্থ বা শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর) আদায়ের হার ছিল ১.০৫ শতাংশ। এরপরও নতুন করে ঋণ অবলোপনকে আত্মঘাতী বলছেন ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা।

এর আগে ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঋণ অবলোপনের নতুন নিয়ম জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই নিয়ম অনুযায়ী, ৩ বছর হলেই মন্দমানের (কু-ঋণ) খেলাপি ঋণ অবলোপন করতে পারবে ব্যাংকগুলো, যা আগে ৫ বছর না হলে এসব খেলাপি ঋণ অবলোপন করা যেত না। এর আগে মাত্র ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ মামলা ছাড়াই অবলোপন করার সুযোগ ছিল। এটা বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম, রাজনৈতিক চাপ ও ওপর মহলের তদবিরে ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বাছ-বিচার ছাড়াই ঋণ অনুমোদন দেয়া খেলাপি ঋণ বাড়ছে। একইভাবে বিভিন্ন অজুহাতে ঋণগ্রহীতার সময়মতো ঋণ ফেরত না দেয়ার কারণেও বাড়ছে খেলাপি ঋণ। যার বড় অংশই মন্দমানে পরিণত হচ্ছে, যা আদায়ের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এ ঋণ ব্যাংকের মূল হিসাবে অতিমাত্রায় স্ফীত হওয়ার আশঙ্কায় ২০০৩ সাল থেকে তা অবলোপনের সুযোগ করে দেয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি খাতের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘হঠাৎ ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অংকে নামিয়ে দেয়ায়, প্রভিশন সংরক্ষণে চাপ তৈরি হয়েছে। আর এ কারণে বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত সময় নিতে হচ্ছে।’

এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুল ইসলাম জানান, ‘প্রতি বছর গ্রাহকদের বিনামূল্যে বিভিন্ন সরকারি সুবিধা দিয়ে থাকি। যেখান থেকে ব্যাংকের কোনো আয় থাকে না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ কাজ আমরা করে আসছি। একই সঙ্গে আমরা ঋণের সুদহার এক অংকে (৯ শতাংশ) নামিয়ে এনেছি। বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বিধবা ভাতা, ছাত্রদের কল্যাণ তহবিলের টাকা। এসব কাজের মূল্য নিলে আমাদের প্রভিশনের কোনো ঘাটতি থাকত না, বরং আয় বৃদ্ধি পেত।’