ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস মারা গেছেন। ভ্যাটিকান পরিচালিত টেলিভিশন চ্যানেলে তাঁর মৃত্যুর খবর প্রচার সাথে সাথে ছড়িয়ে পরে সারা বিশ্বে।
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুতে ক্যাথলিক চার্চে নেমেছে গভীর শোকের ছায়া। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে নতুন পোপ নির্বাচনের দৌড়। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে সামনে আনা হয়েছে।
সম্ভাব্য প্রার্থী যারা-
পিয়েত্রো প্যারোলিন (ইতালি)
৭০ বছর বয়সি প্যারোলিন দীর্ঘ সময় ধরে ভ্যাটিকান সরকারের প্রধান হিসাবে কাজ করছেন। ভ্যাটিকানের সবচেয়ে অভিজ্ঞের মধ্যে তিনি অন্যতম। বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন এবং ভ্যাটিকানের কূটনৈতিক কার্যক্রমে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। ২০১৩ সালে পোপ ফ্রান্সিস তাকে এই পদে নিযুক্ত করেন।
পিয়েরবাত্তিস্তা পিজাবাল্লা (ইতালি)
পিয়েরবাত্তিস্তা পিজাবাল্লা একজন উচ্চপদস্থ ক্যাথলিক ধর্মযাজক এবং বর্তমানে তিনি জেরুজালেমের লাতিন প্যাট্রিয়ার্ক। তিনি ২০২০ সালে এই পদে নিযুক্ত হন এবং পোপ ফ্রান্সিস তাঁকে এই দায়িত্বে নিয়োগ দেন। মধ্যপ্রাচ্যে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
তিনি ইতালির নাগরিক এবং ফ্রান্সিসকান ধর্মসংঘের সদস্য। পিজাবাল্লা মধ্যপ্রাচ্যে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি, সংলাপ ও সহিষ্ণুতার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। এছাড়াও তিনি ইহুদি-খ্রিস্টান সংলাপের একজন বিশিষ্ট প্রবক্তা।
ম্যাটেও মারিয়া জুপ্পি (ইতালি)
৬৯ বয়সী ম্যাটেও মারিয়া জুপ্পি একজন প্রভাবশালী ইতালীয় ক্যাথলিক কার্ডিনাল, যিনি বর্তমানে বলোনিয়ার আর্চবিশপ এবং ইতালীয় বিশপদের সম্মেলনের সভাপতি। তিনি ১৯৮১ সালে পুরোহিত হিসেবে অভিষিক্ত হন।তিনি সান্ত’ এজিদিও সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে শান্তি ও সংলাপ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর, ম্যাটেও জুপ্পি পোপের উত্তরসূরি হিসেবে অন্যতম সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। তাঁর সামাজিক ন্যায়বিচার, শান্তি প্রচার এবং সংলাপের প্রতি প্রতিশ্রুতি তাঁকে এই দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত করে তোলে। তবে, কিছু সমালোচক তাঁর যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি গত কয়েক বছরে ইউরোপীয় শান্তি ও মানবাধিকার বিষয়ে তার দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন।
ক্লডিও গুগেরোত্তি (ইতালি)
ক্লডিও গুগেরোত্তি একজন ইতালীয় ক্যাথলিক কার্ডিনাল এবং বর্তমানে ভ্যাটিকানে “ডিকাস্টারি ফর দ্য ইস্টার্ন চার্চেস” এর প্রিফেক্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পোপ ফ্রান্সিস তাঁকে কার্ডিনাল পদে উন্নীত করেন। বর্তমানে তিনি “সান্ত’আমব্রোজিও দেলা ম্যাসিমা” শিরোনামের কার্ডিনাল-ডিকন।
গুগেরোত্তির পূর্ব চার্চ ও কূটনৈতিক বিষয়ে গভীর জ্ঞান এবং ভ্যাটিকানে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাঁকে পোপ ফ্রান্সিসের উত্তরসূরি হিসেবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে স্থান দিয়েছে।
জ্যঁ-মার্ক এভেলিন (ফ্রান্স)
জ্যঁ-মার্ক এভেলিন একজন ফরাসি ক্যাথলিক কার্ডিনাল এবং বর্তমানে মার্সেইয়ের আর্চবিশপ। ২০১৩ সালে তিনি মার্সেইয়ের সহকারী বিশপ নিযুক্ত হন। ২০১৯ সালে তিনি মার্সেইয়ের আর্চবিশপ হন। ২০২২ সালে পোপ ফ্রান্সিস তাকে কার্ডিনাল পদে উন্নীত করেন এবং সান্তা মারিয়া আই মন্তি গির্জার কার্ডিনাল-প্রিস্ট নিযুক্ত করেন।
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর, এভেলিনকে সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তিনি ফ্রান্সিসের মতাদর্শের ঘনিষ্ঠ, বিশেষ করে অভিবাসন ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে। তবে, তার ইতালীয় ভাষায় সীমিত দক্ষতা পোপের দায়িত্ব পালনে একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
অ্যান্ডার্স আরবোরেলিয়াস (স্বিডেন)
অ্যান্ডার্স আরবোরেলিয়াস একজন সুইডিশ কার্ডিনাল এবং স্টকহোমের ক্যাথলিক বিশপ, যিনি সুইডেনের ইতিহাসে প্রথম কার্ডিনাল হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৪৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সুইজারল্যান্ডের সোরেঙ্গোতে জন্মগ্রহণ করেন এবং লুন্ডে বড় হন। ২০ বছর বয়সে লুথেরান ধর্ম থেকে ক্যাথলিক ধর্মে রূপান্তরিত হন।
১৯৯৮ সালে পোপ জন পল II তাকে স্টকহোমের বিশপ নিযুক্ত করেন, যা সুইডেনের একমাত্র ক্যাথলিক ডায়োসিস। তিনি ৪৫০ বছরের মধ্যে প্রথম জাতিগত সুইডিশ ক্যাথলিক বিশপ।
২০১৭ সালে পোপ ফ্রান্সিস তাকে কার্ডিনাল পদে উন্নীত করেন, যা সুইডেন ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ইতিহাসে প্রথম।পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর, আরবোরেলিয়াসকে সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তার আন্তঃধর্মীয় সংলাপ, অভিবাসন ইস্যুতে কাজ এবং ক্যাথলিক চার্চে সংস্কারের প্রতি প্রতিশ্রুতি তাকে এই দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত করে তোলে।
মারিও গ্রেচ (মাল্টা)
মারিও গ্রেচ একজন মাল্টীয় ক্যাথলিক কার্ডিনাল এবং বর্তমানে ভ্যাটিকানে বিশপদের সিনোডের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পোপ ফ্রান্সিসের সংস্কারমূলক দৃষ্টিভঙ্গির একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে অন্যতম বলে বিবেচিত।
গ্রেচ পোপ ফ্রান্সিসের নেতৃত্বে “সিনোডাল চার্চ” ধারণার অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত। তিনি গ্লোবাল সিনোডাল প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যা ক্যাথলিক চার্চে অংশগ্রহণ, সংলাপ এবং সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করে ।
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর, গ্রেচকে সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাঁর নেতৃত্বে সিনোডাল প্রক্রিয়া এবং সংস্কারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে এই দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত প্রার্থী করে তোলে ।
পিটার এর্দো (হাঙ্গেরি)
পিটার এর্দো একজন হাঙ্গেরিয়ান ক্যাথলিক কার্ডিনাল এবং বর্তমানে এস্টারগম-বুদাপেস্টের আর্চবিশপ ও হাঙ্গেরির প্রাইমেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ক্যাথলিক চার্চের অন্যতম প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা এবং পোপ ফ্রান্সিসের উত্তরসূরি হিসেবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে বিবেচিত।
এর্দো পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে সেতুবন্ধনকারী হিসেবে পরিচিত। তিনি ক্যাথলিক চার্চে ঐক্য ও সংলাপের পক্ষে কাজ করে আসছেন। তাঁর ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ ও সংস্কারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে পোপ ফ্রান্সিসের উত্তরসূরি হিসেবে সম্ভাব্য প্রার্থী করে তোলে।
জ্যঁ-ক্লদ হোলেরিচ (লুক্সেমবার্গ)
জ্যঁ-ক্লদ হোলেরিচ একজন লুক্সেমবার্গীয় ক্যাথলিক কার্ডিনাল এবং বর্তমানে লুক্সেমবার্গের আর্চবিশপ। তিনি পোপ ফ্রান্সিসের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং ক্যাথলিক চার্চে সংস্কার ও সংলাপের পক্ষে একজন প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর।
হোলেরিচ ১৯৯৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত জাপানে সোফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাপানি সংস্কৃতি ও ভাষায় দক্ষ এবং জাপানে দীর্ঘ সময় কাটানোর ফলে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বৈচিত্র্যময় ও আন্তঃসাংস্কৃতিক।
হোলেরিচকে পোপ ফ্রান্সিসের উত্তরসূরি হিসেবে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাঁর সংস্কারমুখী দৃষ্টিভঙ্গি, আন্তঃধর্মীয় সংলাপে আগ্রহ, এবং ইউরোপীয় ক্যাথলিক চার্চে নেতৃত্ব তাঁকে এই দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত প্রার্থী করে তোলে।
লুইস আন্তোনিও ট্যাগলে (ফিলিপিন্স)
লুইস আন্তোনিও ট্যাগলে একজন ফিলিপিনো ক্যাথলিক কার্ডিনাল, যিনি বর্তমানে ভ্যাটিকানে “ডিকাস্টারি ফর এভানজেলাইজেশন”-এর প্রথম প্রচার বিভাগের প্রো-প্রিফেক্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তাঁর সহানুভূতিশীল নেতৃত্ব, সংস্কারমুখী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্বব্যাপী খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযোগ তাঁকে পোপ ফ্রান্সিসের উত্তরসূরি হিসেবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে অন্যতম করে তুলেছে।
ট্যাগলে তাঁর সহানুভূতিশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিচিত। তিনি গরিব ও প্রান্তিক জনগণের পক্ষে কাজ করেন এবং ক্যাথলিক চার্চের মধ্যে LGBTQ সম্প্রদায় ও বিবাহবিচ্ছিন্নদের প্রতি সহানুভূতির আহ্বান জানান। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে “এশিয়ান ফ্রান্সিস” নামে পরিচিত করেছে।
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর, ট্যাগলে পোপের উত্তরসূরি হিসেবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। তাঁর সংস্কারমুখী দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বব্যাপী খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযোগ এবং সহানুভূতিশীল নেতৃত্ব তাঁকে এই দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত প্রার্থী করে তোলে।
চার্লস মাওং বো (মিয়ানমার)
চার্লস মাউং বো মিয়ানমারের প্রথম ক্যাথলিক কার্ডিনাল এবং ইয়াঙ্গুনের আর্চবিশপ। তিনি মিয়ানমারের ক্যাথলিক চার্চের একজন প্রভাবশালী নেতা এবং শান্তি, মানবাধিকার ও ধর্মীয় সংলাপের পক্ষে সক্রিয় কণ্ঠস্বর।
কার্ডিনাল বো শান্তি, মানবাধিকার এবং ধর্মীয় সংলাপের পক্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি রোহিঙ্গা সংকট, সামরিক সহিংসতা এবং সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের সময় মানবিক সহানুভূতির আহ্বান জানিয়েছেন। ২০২৫ সালের মার্চ মাসে মিয়ানমারে ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর তিনি একে “৩৩০টি পারমাণবিক বোমার সমান” বলে বর্ণনা করেন ।
তিনি সম্প্রতি একটি ইস্টার ভিজিল ভাষণে বলেন, “যদিও আমাদের জাতি কষ্টে আছে, তবুও ঈশ্বর আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে সঙ্গী” ।
কার্ডিনাল বো পোপ ফ্রান্সিসের সংস্কারমূলক দৃষ্টিভঙ্গির একজন সমর্থক এবং এশিয়ার একজন প্রভাবশালী ক্যাথলিক নেতা। তাঁর শান্তিপূর্ণ ও সহানুভূতিশীল নেতৃত্ব, আন্তঃধর্মীয় সংলাপে আগ্রহ, এবং মিয়ানমারের কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁর সাহসী ভূমিকা তাঁকে পোপের উত্তরসূরি হিসেবে সম্ভাব্য প্রার্থী করে তোলে।
