
ঈশ্বরদী পৌরশহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়ন। কৃষিপ্রধান এ জনপদে তিন-চার বছর আগেও দু-তিনটি ইটভাটা দেখা যেত। অথচ ছোট্ট এ ইউনিয়নেই এখন ৫২টি অবৈধ ইটভাটা। যেখানে ব্যবহার হচ্ছে কৃষিজমি, কাঠ ও নদীতীরের মাটি। ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকানো চুল্লিগুলো থেকে ছড়াচ্ছে বিষ।
লক্ষ্মীকুণ্ডার কৃষক মজিবুর রহমান দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘কালো ধোঁয়ায় আগের মতো আর চাষবাস হচ্ছে না। গাছপালা মরছে, ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।’ শুধু প্রত্যন্ত এই গ্রাম নয়, রাজধানী ঢাকার চারপাশেও ধোঁয়ার কুণ্ডলী। যেগুলো ধীরে ধীরে ধ্বংস করছে বেঁচে থাকার পরিবেশ, নষ্ট করছে ফসলের ক্ষেত।
সর্বোচ্চ আদালতের হুঁশিয়ারি, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং সতর্কীকরণের মধ্যেও বিষ ছড়াচ্ছে ইটভাটা। সারাদেশেই ইটভাটার বাড়বাড়ন্ত ঘটে চলেছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়ার পর সেগুলো আবার চালু হওয়ার নজিরও আছে।
বাড়ছে অবৈধ ভাটা :পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০১৩ সালে সারাদেশে চার হাজার ৯৫৯টি ইটভাটা ছিল। আর ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে সাত হাজার ৯০২টি। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে আট হাজার ইটভাটা রয়েছে। এই হিসাবে সারাদেশে গত ছয় বছরে ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ৬০ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার ৮৩৭টি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণ করেনি। আর পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই দুই হাজার ৫১৩টির। এ দুটি শর্তই পালন করেনি এমন ইটভাটা রয়েছে তিন হাজারের বেশি।
দেশের সবচেয়ে বেশি ৬৮৮টি অবৈধ ইটভাটা ঢাকা বিভাগে। আর ঢাকার বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশের উৎস ইটভাটা বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, সালফারের পরিমাণ যাচাই না করে এসব ইটভাটায় কয়লা ব্যবহার করতে দেওয়ায় এমনটা ঘটছে। এ ছাড়া অনেক ভাটা জ্বালানি হিসেবে টায়ার ও প্লাস্টিক ব্যবহার করে।
এদিকে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) মাঠ পর্যায়ের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার ৭০০টি। চার হাজার ৮২৫টি ইটভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র বা জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স রয়েছে, যা মোট ভাটার ৫০%।
আইনের প্রয়োগ নেই :২০১৩ সালের ইটভাটা আইন ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংশোধন হয়। এতে ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক কারখানাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। লাইসেন্স না নিয়েও কংক্রিট ব্লক কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আবাসিক, সংরক্ষিত ও বাণিজ্যিক এলাকা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর ও কৃষিজমিতে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। তবে ঢাকা ও ঢাকার আশপাশ ঘুরে বসতবাড়ির খুব কাছে ও আবাদি জমিতে অনেক ইটভাটা দেখা গেছে।
ঢাকার কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারের দেয়ালের চারপাশ ঘিরে কৃষিজমিতে রয়েছে ১৫টি অবৈধ ইটভাটা। কালো ধোঁয়া ও গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে কর্তৃপক্ষ জেলখানার আশপাশ থেকে ইটভাটাগুলো বন্ধের জন্য গত দুই বছরে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ১২ বার চিঠি পাঠিয়েছে। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। এ ছাড়া গাজীপুর সিটি করপোরেশনসহ দেশের বিভিন্ন পৌর ও সিটি এলাকায় ইটভাটা চলছে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, যেসব এলাকা নতুন করে সিটি করপোরেশন কিংবা পৌরসভা ঘোষণা হয়েছে, সেসব এলাকায় আগের ইটভাটাগুলো এখন অবৈধ। আবার আগে নির্মিত কিছু ইটভাটার আশপাশে বসতবাড়ি কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় সেসব ইটভাটাও এখন অবৈধ হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পরিবেশবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত ইটভাটাগুলো আসলে কতটুকু কার্যকরভাবে এসব প্রযুক্তি স্থাপন করেছে, তারও কোনো সামগ্রিক পর্যালোচনা এখনও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে হয়নি। আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না। কারণ, যত দিন থেকে অভিযান চলছে, তাতে অবৈধ ভাটা থাকার কথা নয়।
ইটভাটায় যে ক্ষতি :ইটভাটা শুধু দূষণই ছড়াচ্ছে না, কৃষি ও জনস্বাস্থ্য চরম হুমকিতে। বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপি ও বেলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইটভাটায় বছরে ১২৭ কোটি সিএফটি মাটির প্রয়োজন হয়। বছরে ৩ দশমিক ৫ টন কয়লা ও ১ দশমিক ৯ টন জ্বালানি কাঠ ব্যবহূত হয়, যা থেকে প্রতিবছর ৯ দশমিক ৮ টন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) পরিচালিত গবেষণায় বলা হচ্ছে, ভাটা স্থাপন ও ভূউপরিস্থ মাটি (টপ সয়েল) ব্যবহার করে ইট প্রস্তুতের ফলে প্রতিবছর প্রায় ৪২ হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে। বছরে দেশে প্রায় আড়াই হাজার কোটি ইট তৈরি হয়। এতে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টন মাটি ব্যবহার করা হয়। ফলে প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে।
চাঁদাবাজি :অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের অবৈধ ইটভাটাগুলো প্রশাসন ও প্রভাবশালী মহলকে নিয়মিত মাসোয়ারা দেয়। কিছু জেলায় একেকটি ইটভাটা বছরে পুলিশকে ৫০-৬০ হাজার টাকা, পরিবেশ অধিদপ্তর কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ৫০ হাজার, রাজনৈতিক নেতাদের ৩০-৪০ হাজার টাকাসহ অন্যান্য প্রভাবশালীর পেছনে ২০-৩০ হাজার টাকা খরচ করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি মালিক সমিতির নামে কোনো প্রমাণপত্র ছাড়াই রাজশাহীর ১২৫ ইটভাটার প্রতিটি থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা উত্তোলন করছে একটি মহল। এরই মধ্যে অন্তত ৫০-৬০ জন ব্যবসায়ী চাঁদা দিয়েছেন। আর এ নিয়ে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে রাজশাহী ইটভাটা মালিকদের মধ্যে। নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সাভারসহ দেশের অন্তত ১০টি ইটভাটার মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিয়মিত চাঁদার বাইরেও স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন দিবস পালনসহ নানা উদ্যোগের জন্য চাঁদা দিতে হয় তাদের।
অভিযানে ফল হয় কম :উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বায়ুদূষণ রোধে অবৈধ ভাটা বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, এবার ইট উৎপাদন মৌসুম নভেম্বর-ডিসেম্বরে রাজধানীসহ আশপাশের পাঁচ জেলার ২৬৮টি অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ করা হয়েছে। তবে বন্ধ হওয়া ইটভাটাগুলো আবার চালু হয়ে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ধামরাই উপজেলায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ ছয়টি ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার চালু করেছেন মালিকরা।
ইটভাটা বন্ধের আগে একটি বিস্তারিত গবেষণার দরকার বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। তিনি বলেন, গবেষণা না করে চট করে বন্ধ করে দিলে আবার কয়েক দিন পর আগের জায়গায় ফিরে যেতে হতে পারে।
বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির সহসভাপতি আসাদুর রহমান খান বলেন, ইটভাটা মালিকরা বিনিয়োগ করে ফেলেছেন। ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময় দেওয়া উচিত। ইটের বিকল্প ব্লক কারখানার ব্যাপারে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এর বাজার তৈরি করতে হবে সরকারকে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, ধীরে ধীরে পোড়ানো ইট পরিহার করে পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক উৎপাদনে চলে যাব। যারা ব্লক উৎপাদনে যাবে, আমরা তাদের পাশে থাকব। সরকারি কাজে ২০২৫ সালের মধ্যে শতভাগ ব্লক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।