
বাংলাদেশের খ্যাতিমান স্থপতি মারিনা তাবাসসুম এর “খুদি বাড়ি” অর্জন করেছে আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার- ২০২৫। জলবায়ু পরিবর্তনে বাস্তুচ্যুত মানুষের আবাসন সমস্যার টেকসই সমাধানে বিশেষ অবদানের জন্য এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে।
পুরস্কারের স্টিয়ারিং কমিটির চেয়ারম্যান, মহামান্য প্রিন্স রহিম আগা খান পঞ্চম বলেন, “পরিবেশের প্রতি যত্ন, জ্ঞান ও সহমর্মিতার সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে নির্মাণশিল্পে অনুপ্রাণিত করাই এই পুরস্কারের অন্যতম বড় লক্ষ্য। আজকের স্থাপত্যকে অবশ্যই জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করতে হবে, শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে এবং আমাদের মানবতাকে লালন করতে হবে। এর মধ্য দিয়েই আমরা আশার বীজ বপন করি – নীরব দৃঢ়তার কাজ, যা পরিণত হয় নিরাপদ আশ্রয়ে; যেখানে ভবিষ্যৎ মর্যাদা ও আশায় বিকশিত হতে পারে।”
প্রয়াত প্রিন্স করিম আগা খান চতুর্থ ১৯৭৭ সালে আগা খান পুরস্কার প্রবর্তন করেন। এ পুরস্কারের মাধ্যমে এমন নির্মাণশৈলী চিহ্নিত করে উৎসাহ দেওয়া হয়, যাতে মুসলিম অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। এ পুরস্কারের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় একটি স্থাপনা মানুষের আর্থসামাজিক চাহিদা পূরণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক জীবনে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখে, তা-ও গুরুত্বসহকারে দেখা হয়।
পুরস্কারের আর্থিক মূল্যমান এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিজয়ীদের মধ্যে ভাগ করা হয়, এবং এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ স্থাপত্য পুরস্কার।
প্রতি তিন বছর অন্তর আয়োজিত এ পুরস্কারের ১৬তম আসরের প্রদান অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় টোকতোগুল সাতিলগানোভ কিরগিজ ন্যাশনাল ফিলহারমোনিক-এ। এ অনুষ্ঠানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন উজবেকিস্তানে নিযুক্ত এবং কিরগিজ প্রজাতন্ত্রে এক্রেডিটেড বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম।
উল্লেখ্য, মারিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস ২০১৬ সালেও ঢাকায় অবস্থিত বায়তুর রউফ মসজিদ প্রকল্পের জন্য এ পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।
বাংলাদেশি প্রেক্ষাপট থেকে উদ্ভূত খুদি বাড়ি (“খুদি” অর্থাৎ ছোট্ট ঘর) শত শত মনোনীত প্রকল্পের মধ্যে বিশেষভাবে নজর কাড়ে এর নমনীয়, সাশ্রয়ী ও স্ব-নির্মাণযোগ্য নকশার জন্য। বদলে যাওয়া নদী, চরাঞ্চল এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য সম্মানজনক ও টেকসই আবাসন ব্যবস্থা হিসেবে খুদি বাড়ি তৈরি করা হয়েছে।

বিচারকদের কাছে প্রকল্পটি প্রশংসিত হয়েছে কারণ এটি—
• স্থানীয় উপকরণ ও দক্ষতা ব্যবহার করে: খুদি বাড়ি সহজলভ্য বাঁশ ব্যবহার করে এবং স্থানীয় নির্মাণ কৌশলকে অন্তর্ভুক্ত করে, যার মাধ্যমে জনগণ নিজেরাই ঘর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতায়ন পায়।
• টেকসই নকশা নিশ্চিত করে: বাড়িগুলো বন্যা-সহনশীল, সহজে খোলা ও পুনর্নির্মাণযোগ্য, ফলে পরিবেশের ওপর প্রভাব ন্যূনতম।
• সাশ্রয়ী সমাধান দেয়: প্রতিটি ঘরের খরচ প্রায় ৪৫০ মার্কিন ডলার, যা প্রচলিত বিকল্পের তুলনায় অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।
• বৈশ্বিক প্রয়োগযোগ্যতা দেখিয়েছে: এ মডুলার সিস্টেমটি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে নারী-নেতৃত্বাধীন কমিউনিটি সুবিধা গড়তেও প্রয়োগ করা হয়েছে।
খুদি বাড়ি ছাড়াও আরও ছয়টি প্রকল্প এই পুরস্কার অর্জন করেছে:
• ওয়েস্ট উস্তুটু ভিলেজ কমিউনিটি সেন্টার (চীন): পুনর্ব্যবহৃত ইট দিয়ে নির্মিত একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
• ঐতিহাসিক এসনা পুনরুজ্জীবন (মিশর): শারীরিক ও সামাজিক-অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক পর্যটন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা।
• মাজারাহ রেসিডেন্স ও কমিউনিটি পুনর্নির্মাণ (ইরান): হরমুজ দ্বীপে টেকসই পর্যটন বাসস্থান নির্মাণ।
• জাহাদ মেট্রো প্লাজা (ইরান): তেহরানের একটি জরাজীর্ণ স্টেশনকে রূপান্তর করা হয়েছে প্রাণবন্ত নগর-পরিসরে।
• ভিশন পাকিস্তান (পাকিস্তান): ইসলামাবাদে সুবিধাবঞ্চিত তরুণদের কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানকারী একটি চ্যারিটি সুবিধা।
• ওয়ান্ডার ক্যাবিনেট (প্যালেস্টাইন): বেথলেহেমে কারুশিল্প, নকশা, উদ্ভাবন ও শিক্ষার জন্য অলাভজনক বহু-মুখী কেন্দ্র।
আগা খান আর্কিটেকচার পুরস্কার সম্পর্কে
আগা খান আর্কিটেকচার পুরস্কার পরিচালিত হয় আগা খান ট্রাস্ট ফর কালচার-এর মাধ্যমে, যা আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক (AKDN)-এর একটি সংস্থা। প্রয়াত আগা খান চতুর্থ প্রিন্স করিম আগা খান এ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে ৩০টি দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে AKDN, যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, ক্ষুদ্রঋণ, পরিবেশ, নগর উন্নয়ন, স্থাপত্য, সংস্কৃতি সংরক্ষণসহ এক হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে AKDN প্রতিবছর প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে এবং এর ৯৬ হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করছেন, যাদের বেশিরভাগই উন্নয়নশীল দেশে অবস্থান করছেন।