![স্মার্ট মেয়েরা বিয়ে করে না? ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের](https://oporazoya24.com/wp-content/uploads/2023/07/Untitled-1-9-696x355.png)
জাপানের এক নামকরা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে শিক্ষার্থী ইউনা কাটো। তার ইচ্ছা একজন গবেষক হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু ইউনা খুবই চিন্তিত এই ভেবে যে, বিয়ের পর সন্তানাদি হলে হয়তো তাকে দ্রুতই এই পেশা ছাড়তে হবে।
তিনি জানান, তার আত্মীয়-স্বজনরা প্রথম থেকেই তাকে সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যাথ (এসটিইএম) সম্পর্কিত পড়াশোনা করতে কিংবা এসব বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়তে নিরুৎসাহিত করে আসছেন। তাদের যুক্তি, এসটিইএম ফিল্ডের কাজে অনেক বেশি ব্যস্ততা থাকে।
এর ফলে এসব বিষয়ে কাজ করা নারীরা কাছের মানুষ কিংবা পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারে না। এমনকি এই ফিল্ডে পড়াশোনা কিংবা চাকরি করা মেয়েদের বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজে পেতেও কষ্ট হয়।
ইউনা বলেন, “দাদী আর মা আমাকে প্রায়ই বলতেন, এসটিইএম ফিল্ড বাদে অন্য ফিল্ডে কাজ করতে। নতুবা আমি ভালোভাবে সন্তান লালন-পালন করতে পারব না।”
যদিও ইউনা এসব কথাকে নিজের স্বপ্নপূরণের পথে বাধা হতে দেয়নি। কিন্তু জাপানের এসটিইএম ফিল্ডে পড়াশোনা করতে চাওয়া এমন বহু সম্ভবনাময় নারী শিক্ষার্থী সামাজিক চাপে নিজেদের ইচ্ছা থেকে সরে এসেছেন।
দীর্ঘদিন ধরে জাপানের সামাজিক পরিকাঠামোতে বিদ্যমান এমন ধারণা যেন বর্তমানে মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটির আইটি সেক্টরে প্রায় ৭ লাখ ৯০ হাজারের মতো কর্মী সংকট দেখা যাবে। এ সেক্টরে নারীর পর্যাপ্ত অংশগ্রহণ না থাকা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
জাপান গত শতাব্দীতে উদ্ভাবন, উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের কারণে ধীরে ধীরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের ধারণা, এসটিইএম ফিল্ডে নারীদের সামাজিক এ অবস্থা নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে।
মলিকিউলার বায়োলজিতে পিএইচডি করা চীনা শিক্ষক ইনুও লি বর্তমানে ‘কালচারাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম’ এর অধীনে জাপানে অবস্থান করছেন। নিজের পেশার পাশাপাশি তিনি নিজের তিন সন্তানকে লালন পালনও করছেন।
জাপানে নারীদের প্রতি বিদ্যমান ধারণা সম্পর্কে ইনুও বলেন, “নারীদের এসটিইএম ফিল্ড থেকে দূরে সরিয়ে রাখা দেশের জন্য বেশ ক্ষতিকারক। জেন্ডার সমতা না আনতে পারলে প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে শুন্যতা তৈরি হবে।”
ধনী দেশগুলোর মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানুফ্যাকচারিং ও কন্সট্রাকশন সম্পর্কিত পড়াশোনায় জাপানের নারীদের অবস্থান একেবারে তলানিতে। দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ১৬ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী এ বিষয়গুলোতে পড়াশোনা করছেন।
দেশটিতে গড়ে প্রতি ৭ জন বিজ্ঞানীর মধ্যে মাত্র ১ জন নারী। তবে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এর মতে, জাপানি নারীরা স্কোর তোলার ক্ষেত্রে বিশ্বে গণিতে দ্বিতীয় ও বিজ্ঞানে তৃতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে।
তবে সার্বিক লিঙ্গ সমতা সূচকে জাপানের র্যাংকিং রেকর্ড পরিমাণে নিচে নেমে গেছে। তাই দেশে বিজ্ঞানভিত্তিক পেশার ক্ষেত্রে সমতা আনতে দেশটির সরকারি ও বেসরকারি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে জাপানের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি এ আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়য়গুলো এসটিইএম ফিল্ডে নারীদের পড়াশোনার সুযোগ করে দিতে কোটা পদ্ধতি চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পূর্ববর্তী সময়ে নানা তদন্তে দেখা যায়, দেশটিতে এসটিইএম ফিল্ডে নারীদের পড়াশোনায় ক্ষেত্রে উল্টো আরও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। যেমন, ২০১৮ সালের এক তদন্তে দেখা যায়, টোকিওর একটি মেডিকেল স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় ইচ্ছাকৃতভাবে নারীদের স্কোর কমিয়ে দেওয়া হয়। যাতে করে নারী শিক্ষার্থীদের তুলনায় পুরুষ শিক্ষার্থীরা বেশি ভর্তির সুযোগ পায়।
ওই মেডিকেল স্কুল কর্তৃপক্ষ মনে করে, সন্তান হওয়ার পর নারীরা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে ছেড়ে দেবে কিংবা পড়ালেখা আর চালিয়ে যেতে পারবে না। এমন ধারণা থেকেই তারা এমন পক্ষপাতমূলক আচরণ করে।
এ ধারণার পরিবর্তনে জাপান সরকারের পক্ষ থেকে কয়েক মাস আগে বেশ কয়েকটি জনসচেতনতামূলক ভিডিও তৈরি করা হয়েছে। ভিডিওতে দেখানো হয়, নারীদের এসটিইএম ফিল্ডে পড়াশোনার ক্ষেত্রে ঠিক কী কী উপায়ে শিক্ষক ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা নিজের অজান্তেই ব্যাপক পক্ষপাতমূলক আচরণ করে।
একটি দৃশ্যে দেখা যায়, এক স্কুল শিক্ষক বলছেন নারী শিক্ষার্থীকে বলছেন, “তুমি একজন মেয়ে হয়েও গণিতে ভালো করছ।” এমন কথোপকথনে পরোক্ষভাবে এমন বার্তা দেওয়া হয় যে, একজন নারীর গণিতে দক্ষ হওয়ায় বিষয়টি যেন স্বাভাবিক ব্যাপারই নয়।
আরেকটি দৃশ্যে দেখা যায়, এক মা তার মেয়েকে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করতে অনুৎসাহিত করছেন। মায়ের যুক্তি এই যে, এই ফিল্ডটি পুরুষ শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত।
প্রাইভেট সেক্টরকে যুক্ত করার অংশ হিসেবে, জাপানের জেন্ডার ইকুয়ালিটি ব্যুরো চলতি বছরের গ্রীষ্মেই নারী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ১০০টি এসটিইএম ওয়ার্কশপ ও ইভেন্টের আয়োজন করা হবে।
অন্যদিকে বহু স্কুল ও মিতসুবিসি কিংবা টয়োটার মতো কোম্পানিগুলো এসটিইএম ফিল্ডের নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করছে।
এ সম্পর্কে মিতসুবিসি হেভির হিউম্যান রিসোর্স কর্মকর্তা মিনুরু তানিউরা বলেন, “নারীরা একটি সমাজের অর্ধেক অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে নারী প্রকৌশলীদের পরিমাণ কম থাকার বিষয়টি খুবই অস্বাভাবিক। এক্ষেত্রে নারী প্রকৌশলীদের সংখ্যায় সমতা আনতে না পারলে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে না।”
এমন ধারণার সাথে অনেকটা একমত আরেক কোম্পানি প্যানাসনিক। উদাহরণস্বরূপ, কোম্পানিটি ব্রেড মেশিন তৈরির ক্ষেত্রে নারী প্রকৌশলীদের বেশ ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারছে। কেননা যন্ত্রটির বেশিরভাগ ব্যবহারকারীই নারী।
টোকিও ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির ডেপুটি হেড জুন-ইচি ইমুরা মনে করেন, উদ্ভাবনে বৈচিত্র্য না থাকার ফলে যে নেতিবাচক প্রভাব, সেটি জাপানে ইতোমধ্যেই অনুভূত হচ্ছে। সূত্র: রয়টার্স