সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে ‘নয়াখেল’ এর মৃৎশিল্প

0
58
নয়াখেল এর মৃৎশিল্প

শরীরের অঙ্গে মেখে আছে চিরচেনা মৃত্তিকা। এই বাংলার মৃত্তিকার ঘ্রাণে স্বপ্ন বুনে ‘নয়া খেল’-এর মৃৎশিল্পীরা। এমনি বিভোর স্বপ্নে গড়ে ওঠে নিত্যদিন শ্রীভূমির সম্ভাবনাময়ী নতুন এক দুয়ার। খণ্ড খণ্ড মৃত্তিকার স্তূপ ছড়িয়ে আছে এ বাড়ি, ঐ বাড়ি। কয়েক পা এগোতেই দেখা যায়, বাড়ির উঠনে শীতের মিষ্টি রোদে রাখা আছে চোখ ধাঁধানো হরেক রকমের মাটির তৈজসপত্র।

নিপুণ হাতে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যে ভরপুর তৈজসপত্র দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। মাটির ঘরের আঙিনায় বছর পঞ্চাশের গৃহিণী অনিতা পাল থেকে শুরু করে ১৬ বছরের কিশোরী শিবান্তী রানি পাল গল্পের ছন্দে এটেল মাটিতে তৈজসপত্র তৈরিতে ব্যস্ত। শ্রীভূমির জৈন্তাপুরের সারিঘাটের ‘নয়াখেল’র প্রায় ৩৫টি পরিবার বহুকাল ধরে মৃিশল্পকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। এমনি আবহমান শিল্পকে সৃষ্টি করে নানা বয়সের মৃৎশিল্পীরা অর্থনৈতিকভাবে প্রবৃদ্ধি ঘটিয়ে অনায়াসে জীবনযাত্রা স্বচ্ছতা ফিরে পেয়েছেন তারা।

শ্রীভূমির মাটির এমনি সৃষ্ট চিত্র গোটা বিশ্ব গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে ফের রোমন্থন করে যাচ্ছে সারিঘাটের ‘নয়াখেল’র নিপুণ হাতের মৃৎশিল্পীরা। মহামারিকালেও ওদের জাদু করি হস্তের মৃৎশিল্পের কর্মযজ্ঞ নিস্তেজ হয়নি। এমনি পরিস্থিতিতে মন্ত্রমুগ্ধ হাতের স্পর্শে হাঁড়ি, পাতিল, থালা, দইয়ের পাতিল, জালের কড়া, বন্ধু চুলা, চাটাই, ব্যাংক, কলসি, ঢাকনি,পুতুল, ফুলের তোড়াসহ আরো বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র তৈরি করছে মনের মাধুরী দিয়ে।

তবে এই মৃৎশিল্পের তৈরির উপযুক্ত সময় শীতের মৌসুমে। কেননা বর্ষাকালে মৃত্তিকা দিয়ে তৈরি পণ্য রোদের দেওয়ার মতো বৃহত্তর পরিসরে জায়গা হয় না বৃষ্টির জন্য। তাই স্বল্পপরিসরে ঐ মৌসুমে মাটির তৈজসপত্র তৈরি করা হয়। তৈরি করা মাটির হরেক ধরনের তৈজসপত্র নিম্নে ৫ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত পাইকারি দরে শহরের ব্যবসায়ীদের কাছে বারো মাসব্যাপী বিক্রি করেন ‘নয়াখেল’র মৃৎশিল্পীরা। আর সেই মৃত্তিকার তৈরি পণ্য দোকান ঘরে নিয়ে মনের মাধুরীতে রংবেরঙের তুলির আঁচর বসিয়ে নান্দনিক সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তুলে খুচরা ব্যবসায়ীরা।

বাংলার বহুমুখী সৌন্দর্যে ভরপুর মৃত্তিকার সৃষ্ট পণ্য ক্রয় করতে ভিড় হয় নানা বয়সের ক্রেতারা। বাংলার মানুষের মনে মা ও মাটির প্রতি গভীর ভালোবাসার দুর্বলতা থাকায় শুধু গৃহস্থালি ও পুজো-পাবনের প্রয়োজনে খরিদ করে না, ওরা ঘরে বাইরে সৌন্দর্যবর্ধন কর্মেও মকদ্দমা করে যাচ্ছে। এতে করে মূলধারা মৃৎশিল্পীদের চেয়েও চার গুণ বেশি লাভবান হচ্ছে ছিন্নমূল পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে ‘নয়াখেল’র মৃৎশিল্প শ্রীভূমি শ্রীহট্টের সম্ভাবনাময়ী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চালিকা শক্তি। তাই সারিঘাটের ‘নয়াখেল’র খেটে খাওয়া ৩৫টি মৃৎশিল্পী পরিবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটাতে সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তের স্বপ্ন দেখে নিত্যদিন।

সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলায় সারিঘাটের ‘নয়াখেল’ গ্রামের গৃহিণী শিউলী রানি পাল বলেন, অনেক দিন ধরে নিজ হাতেই মাটি দিয়ে নানা ধরনের পণ্য তৈরি করছি। ছোট-বড় সবাই ঘরের উঠনে বসেই এই কাজ করে থাকে। নিজস্ব ভিটেমাটি আছে, তাই সংসারের খাওয়া-দাওয়াসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খরচপাতি বহন করতে পারি এই শিল্প থেকে।

পাশে থাকা মাটির জালের কড়া তৈরিতে ব্যস্ত কিশোরী শান্তনা রানি পাল বলেন, আমাদের বাড়ি ছাড়াও এই পাড়ার প্রায় ৩৫টি পরিবার শুধু মাটি তৈরি পণ্য থেকে আয়-রোজগার করে থাকে। এমনকি প্রাণঘাতী করোনাকালেও শুধু মাটির জালের কড়া তৈরি করে সংসারের খরচপাতি চালাতে পেরেছি। রসেন্দ্র চন্দ্রপাল জানান, এই মৃৎশিল্প আমাদের বংশানুক্রমে চলে আসছে।

আমাদের দাদা-দাদি, মা-বাবা, ভাই-বোনেরা পূর্বে যা করে এসেছিল, ঠিক একই পেশা আমরাও করে যাচ্ছি। এই শিল্প দিয়ে আটজনের সংসার বেশ ভালোভাবেই চলে যায়। কিন্তু ইচ্ছে হয়, পাইকারি দরে মাটির পণ্য ভুয়োদর্শন না করে নিজ উদ্যোগে বাজারজাত করার মতো একটি দোকান ঘর গড়ে তোলার। যদি তা হয়, তবেই আমাদের মৃৎশিল্প আমরাই পরিচালনা করতে সক্ষম হতাম।

আমাদের মূলধন নেই বলেই পাইকারি দরে মাটির সামগ্রী পণ্য বিক্রি করছি শহরের খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট। অনিতা পাল বলেন, শুকনো মৌসুমে মাটির বিভিন্ন পণ্য বেশি করে তৈরি করা হয়। কেননা বর্ষাকালে চাহিদা থাকলেও বৃষ্টির কারণে ঠিকভাবে তৈরি করা যায় না। কিন্তু সংসারের পরিচালনার জন্য যে পরিমাণের খরচ দরকার তা এই মৃৎশিল্প থেকে আয় হয়। বলা যায়, মাসে প্রায় ১০/১২ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারি।