ম্যানহোল থেকে পাঠাগার আন্দোলনের কাণ্ডারি ইমাম

0
55
ইমাম হোসেন

ইমাম হোসেনের জন্ম ১৯৮৯ সালের ২০ ডিসেম্বর। বাবার নাম মৃত অহিউর রহমান। মায়ের নাম বিলাতের নেসা। পৈতৃক নিবাস কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার সাওড়াতলি গ্রামে।

সীমান্তবর্তী হওয়ায় সেখানকার কিছু যুবক মাদকদ্রব্য আদান-প্রদানের কাজে জড়িত ছিল। অসৎ সঙ্গের একপর্যায়ে পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে যায়। তারপর নিজের বড় ভাইয়ের ওয়ার্কশপে এক মাস কাজ করে পালিয়ে যান চট্টগ্রামের ষোলশহরে।

সেখানে এক মেসে গাদাগাদি করে চার বন্ধু মিলে থাকতেন। একপর্যায়ে তার তিন বন্ধু চলে গেলে অল্প টাকায় মেসে থাকা সম্ভব হয় না। পরবর্তীতে রাতে ঘুমানোর জন্য বেছে নেন রেলের অকেজো বগি। তবে বগি খোলার সময় পুলিশ চোর ভেবে তাকে থানায় নিয়ে যায়।

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বস্তিতে বসবাস শুরু করেন। কাজ করতেন ম্যানহোলে। প্রতিদিন ১২০ টাকা মজুরি পেতেন। ৩০ টাকা দিয়ে তিন বেলার খাবার খেতেন। বাকি ৯০ টাকা দিয়ে পুরোনো বই কিনতেন। বই পড়ায় আগ্রহ থাকায় তিনি নিয়মিত বই কিনতেন এবং সংগ্রহ করতেন।

১৫ দিন পর ম্যানহোলের কাজ ছেড়ে চট্টগ্রাম শপিংমলে দারোয়ানের চাকরি নেন ইমাম। এক মাস চাকরি করে ১ হাজার ২০০ টাকা বেতন পান। সেখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে ৬০টি বই কেনেন তিনি। এত টানাপোড়েনের মধ্যেও বইপড়ার আগ্রহ বিন্দুমাত্র কমেনি।

তিন বছর পর নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় শুরু করেন লেখাপড়া। দশম শ্রেণিতে ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধ পড়ে পাঠাগার গড়ার আগ্রহ জন্মে। সেজন্য ২০০৫ সালে ‘পাঠাগার আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামে একটি পাঠাগার গড়ার উদ্যোগ নেন।

মাধ্যমিকে এ প্লাস পেয়ে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। সংসারে অভাব থাকায় টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ জোগাতেন। তার পাশাপাশি নিজ বাসায় গড়ে তোলেন বিদ্যাসাগর উন্মুক্ত পাঠাগার। নিজেই পোস্টার লাগিয়ে পাঠাগারটির প্রচারণা চালাতেন।

উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত অবস্থায় কুমিল্লার দেবিদ্বারে একটি এতিমখানায় পড়ানোর বিনিময়ে তিনবেলা খাবার পেতেন। শিক্ষার্থীদের জন্য সেখানেও বিদ্যাসাগর উন্মুক্ত পাঠাগারের কিছু বই নিয়ে যান।

মেধাবী এ ছাত্র কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করে চাকরির জন্য সময় ব্যয় না করে পাঠাগার আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার লড়াই শুরু করেন। পাঠাগার আন্দোলন বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ইমাম হোসেন প্রথমে লুৎফর রহমানের মানবজীবন বই দিয়ে শুরু করেন। এখন তার পাঠাগারে বই আছে ১১ হাজার ৫২০টি।

তাদের ট্রাস্টি বোর্ডে সদস্য ১১ জন। অফিশিয়ালি তাদের সদস্য ৪৭২ জন। তারা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাঠাগারের জন্য পুরোনো বই সংগ্রহ করেন। তা ছাড়াও প্রতি বছর বইমেলা থেকেও বই সংগ্রহ করেন। সংগঠনটির লক্ষ্য সারাদেশের ৮৭ হাজার ১২১টি গ্রামে কমিউনিটি পাঠাগার গড়ে তোলা।

সংগঠনটির দাফতরিক কার্যালয় কুমিল্লার ধর্মসাগর উত্তর পাড় পৌড়পার্ক এলাকায়। সংগঠনটির প্রধান কাজ হলো কোনো অঞ্চলে কেউ যদি পাঠাগার গড়তে চান; তাকে উৎসাহ, দিকনির্দেশনা দেয়া এবং পাঠাগার নিয়ন্ত্রণ করা।

তাদের প্রচেষ্টায় দেশের ৪৩টি জেলায় পাঠাগার আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সারাদেশে সংগঠনটির নিয়ন্ত্রণে আছে ১৩৫টি পাঠাগার। পাঠাগার আন্দোলনের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী পাঠাগার গড়তে চাইলে কমপক্ষে ৩০০টি বই থাকতে হয়।

তাদের দিকনির্দেশনায় নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার বিরাজনগর বাজারে প্রথম পাঠাগার গড়ে ওঠে। সেটির নামও দেয়া হয় বিদ্যাসাগর উন্মুক্ত পাঠাগার। ২০১৩ সালের ৭ আগস্ট পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠার দিন প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন ডিসি আবু হেনা মোর্শেদ জামান।