মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ১০ কোটি গ্রাহকের মাইলফলক

0
53
মোবাইল ব্যাংকিং

রাবেয়া বেগম রাজধানীর মিরপুর ভাষানটেক এলাকার একটি গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি করেন। চাকরির উপার্জিত অর্থের একটি অংশ প্রতিমাসের শুরুতেই গ্রামে থাকা বৃদ্ধা মা মর্জিনা বেগমকে পাঠান। মনসুরা বেগম জানান, ‘আগে আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে গ্রামে টাকা পাঠাতাম। এমনও সময় গেছে, খুব জরুরী সময়েও টাকা পাঠাতে পারিনি। এখন নিজের মোবাইল থেকে মায়ের মোবাইলে টাকা পাঠাই মুহূর্তেই।’ দেশে এই মুহূর্তে মনসুরা বেগমের মতো মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটির মাইলফলক অতিক্রম করেছে। যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দৈনিক গড়ে প্রায় ১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হচ্ছে। সে হিসেবে গত জানুয়ারি মাসে মোবাইলে আর্থিক লেনদেন হয়েছে ৫৭ হাজার কোটি টাকা।

জানা গেছে, মূলত সুবিধাবঞ্চিতদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং চালুর অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১১ সালের মার্চে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথমবারের মতো দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে। দেশের সরকারী-বেসরকারী ৫৮টি ব্যাংকের মধ্যে ২৮টি ব্যাংককে এই সেবা চালুর অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ২০টি ব্যাংক সেবাটি চালু করতে পারলেও পরবর্তী সময় পাঁচটি ব্যাংক সেবাটি বন্ধ করে দেয়। ফলে বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা ব্যাংকের সংখ্যা ১৫টিতে নেমে এসেছে। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’, ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের ‘রকেট’ এ সেবায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমএফএস লেনদেনের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, একজন গ্রাহক তার এ্যাকাউন্টে দিনে পাঁচবারে ৩০ হাজার টাকা ক্যাশ ইন বা জমা করতে পারেন। মাসে ২৫ বার সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা ক্যাশ ইন করা যায়। আগে প্রতিদিন দুবারে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা জমা ও মাসে ২০ বারে এক লাখ টাকা ক্যাশ ইন করতে পারতেন গ্রাহকরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দৈনিক গড়ে ১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে। বর্তমানে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেসের মাধ্যমে ৮ ধরনের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এগুলো হলোÑ ইনওয়ার্ড রেমিটেন্স, ক্যাশ-ইন ট্রানজেকশন, ক্যাশ আউট ট্রানজেকশন, পিটুপি ট্রানজেকশন, বেতন বিতরণ (বিটুবি), ইউটিলিটি বিল (পিটুবি), মার্চেন্ট লেনদেন ও সরকারী বিভিন্ন বিল পরিশোধ। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, দরিদ্র ও ব্যাংকিং সেবাবহির্ভূত জনগণকে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করার লক্ষ্যে এবং প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ দ্রুত, সহজ ও নিরাপদে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসরত উপকারভোগীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ২০১০ সালে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের কার্যক্রম শুরু করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে তখন ব্যাপকভাবে সাড়া দেয় তফসিলি ব্যাংকগুলো। যার ফলে আজ মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহক সংখ্যা ১০ কোটির মাইলফলক অতিক্রম করেছে। ড. আতিউর রহমান বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণের একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। তিনি বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় খোলা ব্যাংক হিসাবগুলোকে ধরলে গ্রাহকের দিক দিয়ে প্রথম দিকে থাকবে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত জানুয়ারি মাসে মোবাইলের মাধ্যমে পার্সন টু পার্সন বা এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে লেনদেন হয়েছে ১৭ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। আগের মাস ডিসেম্বরে এই লেনদেন ছিল ১৬ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের একজন গ্রাহক মামুন-অর-রশীদ জানান, দেশের সুপারশপগুলোতে এখন মোবাইলের মাধ্যমেই লেনদেন বেশি হয়। বিকাশ, রকেট, নগদসহ অন্যান্য ব্যাংক এখন ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ক্যাশব্যাক অফার দেয়। এতে কেনাকাটার পাশাপাশি সাশ্রয়ও হয় কিছু টাকা। এসব লেনদেন ব্যক্তিগত হিসেবের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয় বলে জানা গেছে। পার্সন টু পার্সন পেমেন্টস (পিটুপি) হলো একটি অনলাইন প্রযুক্তি। যার মাধ্যমে গ্রাহকরা তাদের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ড থেকে অন্য ব্যক্তির এ্যাকাউন্টে ইন্টারনেট বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তহবিল স্থানান্তর করতে পারে।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শুধু টাকা পাঠানো বা উঠানো নয়, কেনাকাটা, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, বেতনভাতা বিতরণ, সরকারী অনুদানপ্রাপ্তি, মোবাইলে তাতক্ষণিক ব্যালেন্স রিচার্জসহ বিভিন্ন সেবা এখন হাতের মুঠোয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের হেড অব কর্পোরেট কমিউনিকেশন্স শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, প্রতিদিনের আর্থিক লেনদেন সহজ, সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও তাৎক্ষণিক করতে উদ্ভাবনী, সৃজনশীল এবং সময়োপযোগী সেবা সংযুক্ত করে চলেছে বিকাশ। এখন একজন গ্রাহক দেশের যেকোন স্থানে যে কোন সময় বিকাশ দিয়েই তার প্রতিদিনের প্রায় সব ধরনের লেনদেন সম্পন্ন করতে পারেন, যা বিকাশের প্রতি আস্থার স্বীকৃতি। বর্তমানে দেশে ৫ কোটি ১০ লাখের বেশি বিকাশ গ্রাহক রয়েছে।

দেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ২৬টি ব্যাংকসহ ভিসা ও মাস্টার কার্ড থেকে অনায়েসে নিজের এবং প্রিয়জনের বিকাশে টাকা আনার সুযোগ রয়েছে। বিকাশ থেকেই থেকে পল্লী বিদ্যুত, নেসকো, ডেসকোসহ সব বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানি, ওয়াসা, গ্যাস বিল, ইন্টারনেট বিল, বিটিসিএলসহ আরও নানা ধরনের বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে। এছাড়া বিকাশ থেকে যখন তখন মোবাইল রিচার্জ, সব ধরনের টিকেট কেনা, বিদেশ থেকে রেমিটেন্স গ্রহণ করাসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা পাচ্ছেন গ্রাহকরা। তিনি আরও বলেন, আর্থিক লেনদেনে গ্রাহককে নিজের টাকা ব্যবহারে আরও সক্ষমতা ও স্বাধীনতা দিতে কাজ করে যাচ্ছি আমরা।