করোনা মহামারির মধ্যে লকডাউনের বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে পুলিশকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন-২০১৮’ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এই আইন সংশোধন হলে কেউ লকডাউনের বিধিনিষেধ না মানলে পুলিশ তাকে শাস্তি দিতে বা জরিমানা করতে পারবে। তবে কী ধরনের শাস্তি পুলিশ দিতে পারবে, সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। ইতিমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে সংশোধনীর প্রস্তাবনা চাওয়া হয়েছে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘এখনই পুলিশকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে না। এই মহামারি কত দিন থাকবে, সেটা তো আমরা জানি না। এ কারণে পুলিশকে কিছু ক্ষমতা দেওয়ার উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। লকডাউন বাস্তবায়নে পুলিশের হাতে তো আসলে কোনো ক্ষমতা নেই। কাউকে তো তারা মাস্ক পরতে বাধ্য করতে পারছে না। তাই আমরা আলাপ-আলোচনা করছি। এর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আইনটির কী সংশোধন করে পুলিশকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া যায়, সেটা জানিয়ে প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে প্রস্তাব পেলে সেটা মন্ত্রিসভার বৈঠকে উঠবে। এরপর আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত লাগবে। সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে অধ্যাদেশ জারি হবে। তবে কাজটা এই মুহূর্তেই হচ্ছে না। আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, বাস্তবায়ন করতে একটু সময় লাগবে।’
‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন-২০১৮’ অনুযায়ী জেলার সিভিল সার্জনরা আইনটি প্রয়োগ করতে পারেন। অন্যদের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। এখানে কিছু সংশোধনী এনে সিভিল সার্জনদের পাশাপাশি পুলিশকেও কিছু ক্ষমতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কেউ মাস্ক না পরলে বা সরকারি বিধিনিষেধ না মানলে পুলিশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শাস্তি বা জরিমানা করতে পারবে। এখন কী পরিমাণ শাস্তি দেওয়া যাবে বা কত টাকা জরিমানা তারা করতে পারবে, সেটা আইনের সংশোধনীতে উল্লেখ করা হবে।
জানতে চাইলে সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘পুলিশকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন-২০১৮ অনুযায়ী সিভিল সার্জনদের কিছু ক্ষমতা দেওয়া আছে। কিন্তু এখানে পুলিশের কোনো ক্ষমতা নেই। এই যে ঈদের আগে হাজার হাজার মানুষ ফেরিতে গিয়ে উঠল, পুলিশের তো কিছুই বলার নেই। কেউ মাস্ক পরছে না, সেখানেও পুলিশের কিছু বলার নেই। ফলে মাঠ পর্যায়ে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে পুলিশকে কিছু ক্ষমতা দিতে হবে। আবার বিপত্তিটা হলো, পুলিশ ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করেই অভ্যস্ত। এখন এই ক্ষমতাটা পেলে যে অপপ্রয়োগ করবে না, সেটা তো কেউ বলতে পারে না। তবে পুলিশের যারা দায়িত্বশীল আছেন, তারা যদি ঠিকমতো দেখভাল করেন, তাহলে আমি পুলিশকে এই মুহূর্তে এই ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে।’
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘পুলিশের কাছে এ ধরনের ক্ষমতা দেওয়ায় আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো সংকট দেখি না। পুলিশ তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করছে। কেউ ট্রাফিক আইন না মানলে তাকে তো জরিমানা করছে। এখন লকডাউন বাস্তবায়ন করতে গেলে পুলিশকে কিছু ক্ষমতা তো দিতে হবে। তা না হলে তারা এটা বাস্তবায়ন করবে কীভাবে? সবকিছুতেই সন্দেহ করলে হবে না। কাউকে না কাউকে তো বিশ্বাস করতে হবে। এখন আপনি পুলিশ ছাড়া কি কোনো কাজ করতে পারেন? চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, দুর্ঘটনা—সবকিছুতেই পুলিশ লাগে। তবে হয়েছে কী, আইনের কিছু অপপ্রয়োগের কারণে মানুষের মধ্যে এই সন্দেহটা তৈরি হয়েছে। কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এটা বাস্তবায়ন করা গেলে খুব একটা সমস্যা হবে বলে আমি মনে করি না। বরং ভালো ফল মিলবে।’
তবে পুলিশকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে নন মানবাধিকারকর্মীরা। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, পুলিশের হাতে এখন অনেক ক্ষমতা। সেটাই তারা অপপ্রয়োগ করছে। এখন যদি তাদের নতুন করে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয়, তাহলে মানুষ আরো বেশি হয়রানির শিকার হবে। ফলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরাই এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। পুলিশকে এই ক্ষমতা দেওয়া একেবারেই ঠিক হবে না।
আরেক জন মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন বলেন, ‘আমি মনে করি, পুলিশের হাতে এই ক্ষমতা দেওয়া উচিত নয়। আসলে সমস্যা কি জানেন? আমাদের সরকারই তো নিজেদের সিদ্ধান্ত ঠিক রাখতে পারছে না। সকালে বলছে লকডাউন, বিকেলে ব্যবসায়ীদের চাপে দোকান খুলে দিচ্ছে। সরকার যদি কড়া বার্তা দিতে পারত, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। পুলিশ তো মানুষের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা মেশে। ফলে যিনি তদন্ত করবেন, তিনিই যদি বিচারক হন, তাহলে সুবিচার পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যাবে।’