পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা বন্দী জলের ‘আন্দুগাঙ’

0
57
পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা বন্দী জলের আন্দুগাঙ

যাতায়াতের দুই সড়কপথই সুন্দর। কোনো যাতায়াত বিড়ম্বনা ছাড়াই ঘণ্টা দুয়েকে পৌঁছানো যায়। আন্দুর জলবন্দি রূপ দেখতে হলে সকাল কিংবা বিকেলটা সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। সড়ক লাগোয়া হাট। সোজাসাপ্টা নাম সড়কের বাজার। সিলেটের সীমান্ত উপজেলা কানাইঘাটের এই হাটে গেলে একপথে মাড়ানো যায় আরও তিনটি উপজেলা সদর। গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জ। যেন এক গন্তব্যে চার উপজেলা পাড়ি।

যেতে যেতে এমন রোমাঞ্চ যাত্রার মধ্যভাগে বিরতিতে ফের নামকরণ বিস্ময়। যেখানে গাড়ি থামল, সেখানকার নাম জুলাই। চোখে ভাসে ইংরেজি বর্ষপঞ্জি। গ্রামের নাম জুলাই। আগে কিংবা পরে আর কিছু নেই। তাহলে কি জুলাই বাদে অন্যান্য মাসের নামে আরও মিলবে জনবসতি?

এমন প্রশ্ন আর বিস্ময়ে কানাইঘাটের তরুণ ব্যবসায়ী কাওসার আহমদ সহাস্যে জানালেন, ব্রিটিশ শাসনামলে এই নামকরণ। জুলাই গ্রামের মধ্যে ৯টি মহল্লা আছে। সেগুলো নিজস্ব নামে পরিচিতি। ডাকঘর জুলাই হওয়ায় মৌজার নামও পড়েছে এই নামে। জুলাই আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও আছে। কেন এমন নামকরণ?

লোকমুখে শোনা প্রচলিত কথা জানালেন কাওসার। তাঁর ভাষ্য, ইংরেজি বছরের মধ্যবর্তী সময়ে বসতির গোড়াপত্তন হয়েছিল। জুলাই নামের মাহাত্ম্যটা এখানেই। শতবর্ষী জনপদ জুলাই গ্রামে বসেই শোনা গেল একটি গল্প। সেই গল্পের শুরুতে আবার নাম-বিস্ময়। একটি গাঙ, নাম আন্দু। আন্দুগাঙ বলে ডাকা হয়। জুলাই নামটি তলিয়ে গেল এই নামটি শুনে।

‘আন্দু’ সিলেটের আঞ্চলিক শব্দ। অনর্থক বা ‌খামোখা অর্থেই ব্যবহৃত হয়। সিলেটে কথাকে বলা হয় মাত। কথাবার্তায় অনর্থক কিছু শোনা গেলে ভর্ৎসনা শুনতে হয় আন্দুমাত বলে। নদী বা গাঙের নাম কেন আন্দু? এ প্রশ্নের উত্তর জানতেই গত বৃহস্পতিবার আন্দুগাঙ যাওয়া।

সিলেটের দীর্ঘতম নদী সুরমা। কানাইঘাট থেকে গোলাপগঞ্জ, সিলেট শহর ঘুরে সুনামগঞ্জ জেলায় প্রবহমান। সুরমার ক্ষয়িষ্ণু রূপ উৎসমুখ এলাকা কানাইঘাটেও। শুষ্ককালের এই সময়ে সেতু থেকে নদীর উভয় দিকে তাকালে নদীর জল যেন তলানিতে গিয়ে ঠেকছে দেখায়।

ফাল্গুন-চৈত্র মাসে সুরমার বুকে অনেক স্থানে হাঁটুজলও মেলে না। নাব্যতা হারানো এই সুরমার একটি অংশে বড় রকমের পরিবর্তন দেখা দেয় কানাইঘাট উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন লক্ষ্মীপ্রসাদ, দিঘিরপাড় (পূর্ব) ও সাতবাঁকে। ১৮৯৭ সালে সিলেট অঞ্চলে ‘বড় ভৈসাল’ খ্যাত ভূমিকম্পের পর বদলে যায় সুরমার গতিপথ। জুলাই গ্রামের দিকে যাওয়া সুরমায় তখন সর্বপ্লাবী স্রোত।

আশপাশের মানুষের নিরাপদ বসবাসে ব্যাঘাত ঘটে। বড় ভৈসালে সুরমা নদী নিয়ে বিপাকে পড়ায় বছর দুয়েক পর নদীর এপাড়-ওপাড়ে স্থায়ী বাঁধ দেওয়া হয়। সেই থেকে সুরমার একটি অংশের জলধারা বন্দী হয়ে পড়ে। গাঙের এই জলে কোনো তরঙ্গ নেই। যেন অনর্থক জলাধার। দেখা থেকে নাম পড়ে আন্দুগাঙ।

উত্তর-পশ্চিম তীরে গ্রাম্য হাট। ব্রিটিশ আমলে এই হাটের বেশ কদর ছিল। জমজমাট হওয়ায় নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গঞ্জ। কয়েকটি গঞ্জ মিলে একটি শহর হয়। সেটি সেকালে আর শহর হয়নি। এখন সাদামাটা ভবানীগঞ্জ বাজার।

আন্দুগাঙে ভর করে চলে এই হাট। একটি খেয়া আছে পারাপারের। খেয়া পার হওয়ার সময় গাঙে বাঁধ দেওয়ার গল্পটি ব্রিটিশ আমলের বলে নির্দিষ্ট করে জানালেন ভবানীগঞ্জের বাসিন্দা ইয়াসিন মিয়া। তাঁর দাদাসহ এলাকার প্রবীণদের মুখে এখনো প্রচলিত আছে আন্দুগাঙের জন্মশতবর্ষ পেরোনোর কথা।

আন্দুগাঙের জন্মবৃত্তান্ত সন-তারিখ আর কিছু পুরোনো নথিপত্রের তত্ত্ব-তালাশ দিলেন সিলেট অঞ্চলের পুরাকীর্তির সংগঠক আবদুল হাই আল-হাদী। তিনি ‘সেভ দ্য হেরিটেজ’ নামের একটি সংগঠনের সমন্বয়ক। ইতিহাস ঘেঁটে আল-হাদী জানালেন, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কূলঘেঁষা কানাইঘাট ব্রিটিশ আমলে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল।

এ জন্য ১৮৯৭ সালের বড় ভূমিকম্পের পর অবকাঠামোগত পরিবর্তনে ব্রিটিশ সরকার তাৎক্ষণিক অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিল এই জনপদের মানুষের নিরাপদ বসবাসের সুবিধায়। সেই সব উদ্যোগের একটি দৃশ্যমান এই আন্দুগাঙে। ভূমিকম্পে গতিপথ হারানো সুরমার তীব্র স্রোত বন্দী করে রাখা হয়েছিল। নদীর জলকে বন্দী করে রাখার চিহ্ন বহন করছে আন্দুগাঙ।