একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের ক্ষমা আজও চায়নি পাকিস্তান

0
64

একাত্তরের গণহত্যার জন্য আজও ক্ষমা চায়নি পাকিস্তান। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক-সেনারা বর্বরোচিত আক্রমণ চালিয়ে ৩০ লক্ষ নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করলেও সমানে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ, অতীতের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে বহু দেশ। কিন্তু পাকিস্তান সেই পথে হাঁটতে নারাজ। তাই পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্বের প্রশ্নটিও এদেশের বহু নাগরিক মেনে নিতে পারেন না।

মহান মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে পাওয়া মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতেও পাকিস্তান যদি তাদের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা না চায়, তবে বন্ধুত্বের প্রশ্নই ওঠেনা। এমনটাই মনে করেন মহান মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরী বাংলাদেশের নবপ্রজন্ম।

অতীতের ভুল স্বীকার করে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা বিভিন্ন সময় যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। এমন নজির বহু রয়েছে।

বিশ্বযুদ্ধের সময় পোলান্ড-সহ ইওরোপের বিভিন্ন দেশে হত্যাকাণ্ড চালানোর অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েন জার্মান কাষ্ট্রনায়ক ফ্রাঙ্ক-ওয়াল্টার স্টেনিমিয়ার। দক্ষিণ আফ্রিকাও রাষ্ট্র হিসাবে ক্ষমা চেয়েছে নাইজেরিয়ায় অত্যাচারের জন্য। নিউজিল্যান্ড এক সময়ে অত্যাচার চালিয়েছিল মাওরি উপজাতিদের ওপর। সেই অত্যাচারের জন্য রাষ্ট্র হিসাবে ক্ষমাও চেয়েছে তারা।

জাপান ক্ষমা চেয়েছে কোরিয়ার ও মাঞ্চুরিয়ার কাছে। এমনকী, ভারতের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের জন্য ব্রিটিশরাো ক্ষমা চেয়েছে।

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের শতবর্ষ পূর্তির তিন দিন আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেন, ‘২০১৯-এর জালিয়ানওয়ালবাগকাণ্ড ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান ইতিহাসের অত্যন্ত নিন্দাজনক অধ্যায়। আমরা সেই ঘটনার জন্য অত্যন্ত অনুতপ্ত।’

ঘটনার শতবর্ষ পরে হলেও ব্রিটিশরা বুঝে নিরীহ মানুষদের হত্যা করা কখনওই কোনও সভ্যতার সূচক হতে পারেনা। ব্রিটিশ ফরেন অফিসের মিনিস্টার অফ স্টেট মার্ক ফিল্ড হাউজ অফ কমোনসে জলিয়ানওলাবাগ নিয়ে স্পষ্ট বলেন, ‘সেটা ছিল খুবই দুঃখজনক ঘটনা। শুধু হাউজের মধ্যেই দুঃখপ্রকাশ করছিনা। গোটা দুনিয়াকেই বলতে চাই, অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল জালিয়ানওয়ালাবাগে। ব্রিটিশ ইতিহাসে অত্যন্ত নিন্দাজনক ঘটনা।’

অথচ, ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধকে ধংস করতে পাকিস্তান যে লাগাতর আক্রমণ চালিয়েছিল সটা ছিল জালিয়ানওয়ালাবাগের থেকেও বর্বরোচিত। নৃশংস গণহত্যা চালায় পাক-সেনা।

লাগামছাড়া অত্যাচারে ৩০ লাখ বাঙালি প্রাণ হারান। পাকিস্তানি সেনা আর তাদের দেশীয় ইনুচর রাজাকার-আল বদররা বাঙালি জাতিকেই ধংস করার ষরযন্ত্রে সামিল হয়েছিল সেদিন। বাংলার মাটি রক্তাক্ত হয়ে ওঠে তাদের সম্মিলিত অত্যাচারে।

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওয়ার এনকোয়ারি কমিশনের রিপোর্ট মেনে যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি ছিল বাধ্যতামূলক। চুক্তিতে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, পাকিস্তান সরকার তাদের সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের নিন্দা করে গভীর অনুশোচনা প্রকাশ করবে। সেইসঙ্গে পাক-প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণের কাছে অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবেন। কিন্তু আজও সেটা করেনি। বরং চুক্তির শর্ত মেনে পাকিস্তানি ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে তাদের হাতে তুলে দেয় বাংলাদেশ। এই যুদ্ধ বন্দি ১৯৫ জন বাংলাদেশের মাটিতে নৃশংস হত্যাকান্ড চালায়। তবু ক্ষমা চায়নি অসলামাবাদ। ১৯৭৪ সালে

পাক-প্রধানমন্ত্রী জুলফিকর আলি ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এসে উল্টে গণহত্যা ও পাক-সেনার বর্বরতার দায়ও অস্বীকার করেন। তার ঔধত্য আঘাত করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে। ভুট্টোর পরবর্তীতেও পাক-শাসকরা একাত্তরে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাোয়ার প্রয়োজনই মনে করেনি।

অথচ, ১৯৭১-এ অপারেশন সার্চ লাইটের নামে অগণিকত নিরীহ মানুষকে সেদিন হত্যা করে পাক-সেনা। ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ সেদিন প্রাণ হারান। হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে অন্তত ১ কোটি মানুষ নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে ভারতের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীরা তাঁদের বাংলাদেশি সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে অন্তত সাড়ে তিন লাখ নারীকে ধর্ষণ করে। মানবাধিকার লঙ্ঘন করে নারীদের পন্য হিসাবে ব্যবহার করে পাক-সেনারা। বহু নারী তাই সমাজ বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান পাক-সেনাদের লালসার কারণে। পাকিস্তানের প্রয়াত মেজর জেনারেল খাদিম হুসেন রেজা তাঁর ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি–ইস্ট পাকিস্তান’ বইটিতে কিছুটা বিবরণ তুলে ধরেছেন। বইটি ওক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশ করেছে। সেখানে জেনারেল এএকে নিয়াজির বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। নিয়াজি বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের নারীদের ভাষা-সংস্কৃতির পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর সেনাদের লিলা করতে দিয়েছিলেন। এমনই ছিল অত্যাচারের বহর।

বাঙালি তরুণীদের সহজলভ্য পণ্য করে তোলা হয়েছিল। এক ছাউনি থেকে অন্য সেনা ছাউনিতে তাঁদের ভোগ্য পণ্য হিসাবে ভেট পাঠানো হতো। তাঁদের গোপন অঙ্গে বন্দুকের ব্রেয়নেট দিয়ে আঘাত করারও বহু উদাহরণ রয়েছে। বহু নারীর শরীর ভোগ করার পর তাঁদের ছাউনির বাইরে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। নারীর প্রতি ব্যাভিচার আর আবালবৃদ্ধবনিতার ওপর নৃশংস অত্যাতারের মৃগয়া ভূমি হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। অথচ সেই অত্যাচারের জন্য আজও ক্ষমা চায়নি পাকিস্তান।

ওয়ার এনকোয়ারি কমিশন বা হামদুর রহমান কমিশন গঠন করেছিল পাকিস্তান। সেই কমিশনও পাকিস্তানি সেনা অত্যাচারের কথা স্বীকার করে। কমিশনের রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, সামরিক ও অসামরিক নেতৃত্বের ব্যর্থতাউ পূর্ব পাকিস্তানে পরাজয়ের কারণ। কিন্তু পারভেজ মুশারফের সামরিক সরকার সেই রিপোর্টকে অস্বীকার করে। কারণ রিপোর্টে পাকিস্তানি সেনার ধর্ষণে, গণহত্যা-সহ সকল অত্যাচারের কথা বলা হয়েছিল। মুশারফ ২০০২ সালে ঢাকা সফরে এসেও ‘অনুশোচনা’ প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন। একাত্তরের ঘটনার জন্য নিজের ‘বেদনা’র কথা বলেন তিনি। তাঁর এই ছলনা ধরে ফেলেন আওয়ামি লিগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব। সুশীল সমাজ থেকেও দাবি ওঠেন, বেদনা নয়, মুশারফকে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু তিনি চাননি।

মুশারফ ক্ষমা চাওয়ার বদলে চাইছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপর্ব বন্ধ রাখুক বাংলাদেশ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। আর তাই ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তান হাইকমিশন সমানে উত্যক্ত করার চেষ্টা করছে। সবসময়ই লক্ষ্য করা যায় পাকিস্তানি কূটনীতিকদের নেতিবাচক কার্যকলাপ। তাই মাঝেমধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রককে কড়া দাওয়াইও দিতে হচ্ছে। দেশনেত্রী হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন আসলে পাকিস্তানের চক্ষুশূল। তাই মাঝেমধ্যেই নানা কারণে নব্য রাজাকারদের সাহায্যে বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা চালানোর চেষ্টাকে মদত দেওয়ার কেন্দজ্রভূমি হয়ে উঠছে পাত-দূতাবাস।

পাকিস্তান মাঝে মধ্যেই বাংলাদেশের বিভিন্ন ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এমনকী, তাঁদের দুতাবাসের কাজকর্মেো নাকি ঢাকা হস্তক্ষেপ করে। বাংলাদেশের মাটিতে পাক-বিরোধী কাজকর্মকেও নাকি বাংলাদেশ মদত দেয়। বিশেষ করে বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে গোটা বাংলাদেশই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। এটাই তো স্বাভাবিক।

মানব সভ্যতা্র ইতিহাসে একাত্তরের মতো বর্বরতার উদাহরণ খুব কম আছে। হিটলারের ন্যাতজি বাহিনীকেও হার মানিয়েছিল পাক-সেনা। কিন্তু জার্মানি বিশ্বযুদ্ধের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। পাকিস্তান আজও সেই সৌজন্য দেখায়নি। বরং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের মিলিনিয়াম শীর্ষ সম্মেলনে সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে কথা বলায় নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেছিলেন জেনারেল মুশারফ। ক্ষমা তো চায়নি আজও। বরং মুশারফের দেখানো পথেই হেংটে চলেছেন সেনা বাহিনীর হাতের পুতুল ইমরান খানও। ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নে পাকিস্তানের আন্তরিকতা নিয়ে তাই প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।